গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরে দেখা হয় জিদান হাওলাদার জনির সঙ্গে। বাগেরহাটের হুমায়ুন কবির হাওলাদারের ছেলে জনি মালয়েশিয়ায় পা রাখেন ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল। ক্লিনারের চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁকে কুয়ালালামপুরে নিয়ে যায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠান পিএসএল রিসোর্সেস। কিন্তু কথা রাখেনি নিয়োগদাতা। দুই বছরে সাতটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করানো হয় তাঁকে। বিভিন্ন খাত দেখিয়ে তাঁর বেতন-ভাতা থেকে প্রায় অর্ধেকটা কেটে রাখা হয়।
২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক গেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৪ জন। এরাসহ মালয়েশিয়ায় এখন বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন। দুই দেশের এই শ্রমিক বাণিজ্যে জড়িয়ে আছে ভালো-মন্দ মিলিয়ে নানান প্রতিষ্ঠান; আর তাদের তত্পরতায় শ্রমিকদের অবস্থাও ভালো-মন্দ মিলিয়ে। ভালোর সংখ্যাই বেশি, তবে মন্দও কম নয়। ভালোরা ভালো থাকুক; কালের কণ্ঠ দৃষ্টি দিয়েছে বিপন্ন শ্রমিকদের দিকে, যারা একবুক স্বপ্ন নিয়ে সর্বস্ব ব্যয় করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়ে আজ স্বপ্নহত্যার শিকার। দুই দেশে গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে বের করে আনা হয়েছে দেশের ছেলেদের এই করুণ পরিণতির নেপথ্য নিয়ামক। এই আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে কালের কণ্ঠর সহযোগী হয়েছে ওই দেশের স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যম মালয়েশিয়াকিনি।
এ নিয়ে আজ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদন-১ পড়ুন… মালয়েশিয়ায় কম্পানি খুলে দাস ব্যবসা
কেন এক পেশার কর্মীকে অন্য পেশায় কাজ করাচ্ছেন, কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন করা হলে পিএসএল রিসোর্সেসের পরিচালক লগেসরন জবাব দেন, ‘আমার সব কর্মী ক্লিনারের কাজ করে, অন্য কিছু না। জিদান কেন, কাউকেই কখনো কিচেনের কাজে দেওয়া হয়নি।’
কর্মীদের এক ঘরে গাদাগাদি করে মানবেতর পরিবেশে রাখা হয়— অভিযোগটি তুলে ধরলে মি. লগিস দাবি করেন, ‘আমাদের অধিকাংশ কর্মীকে আমরা সুরক্ষিত হোস্টেলে রাখি। প্রতিটা ঘরে রান্নাবাড়ার সুবিধাসহ ডবল বেড, মেট্রেস, বালিশ সব আমরা দিয়ে থাকি।’
‘আপনাদের কর্মীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে আড়াই হাজার-তিন হাজার রিঙ্গিত বেতনে কাজ করিয়ে আপনারা তাঁকে দিচ্ছেন এক হাজার রিঙ্গিত; কেন?’
জবাবে পিএসএল পরিচালক বলেন, ‘বিদেশ থেকে এসে একজন শ্রমিক বা ক্লিনার কীভাবে মাসে তিন হাজার রিঙ্গিত আয় করতে পারে, আমি বুঝি না। দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজে যখন তার মূল বেতন এক হাজার রিঙ্গিত, তখন সে যদি মাসে ২৬ দিন ৮ ঘণ্টা করে এবং ছুটির চার দিন ওভারটাইমও করে, তবে তার বেতন ১৭০০ রিঙ্গিতের কিছু বেশি হতে পারে। এমনকি স্থানীয় কোনো শ্রমিকও ক্লিনাারের কাজ করে মাসে তিন হাজার রিঙ্গিত আয় করতে পারে না। কাজই ওইসব অভিযোগ সত্য নয়।’
জিদানের বেতন থেকে টাকা কেটে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে লগেসরন বলেন, ‘আমি সচরাচর কোনো শ্রমিকের মজুরি কর্তন করি না। তবে এখানে যার কথা বলা হচ্ছে, তার সম্পর্কে আমি জানি। তাকে আমি ফেরত পাঠিয়েছি কারণ সে মাদক ও স্থানীয় মেয়েদের সঙ্গে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। তার বেতন থেকে যেটা কেটেছি, সেটা তার দেশে ফেরার টিকিট বাবদ।’
পিএসএল পরিচালক হুমকির সুরে বলেন, তার ভাগ্য ভালো যে, তাকে আমি পুলিশে দিইনি। তার এক আপন ভাই এখনও আমার এখানে কাজ করছে এবং সে পুরো বিষয়টা জানে। তাকে জিজ্ঞেস করলেই তো জানতে পারবেন, ওই ছেলেটা কেমন।’
পরিচালক আরো বলেন, ‘ওর বেতন থেকে কিছু টাকা কাটা হয়েছে হোস্টেলে ভাঙচুর করে জিনিসপত্র নষ্ট করার কারণে।’
জানুয়ারি মাসে ১৫ দিনের বেতন দিয়েছেন কেন— প্রশ্ন করলে পিএসএল পরিচালক বলেন, ‘কারণ সে ১৫ দিনই কাজ করেছে। এরপর সে চার মাস ধরে উধাও।’
পিএসএল পরিচালকের এই সাক্ষাত্কার পাওয়ার পর কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক আবার যোগাযোগ করেন জিদান জনির সঙ্গে। আপন ভাই ও মাদকের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েন জনি। বলেন, ‘আমরা দুই ভাই-বোন। ওখানে আমার আপন ভাই এলো কোত্থেকে? আর মাদক দূরের কথা, আমি সিগারেটও খাই না। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে দেশে সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ করে মেডিক্যাল টেস্ট করালাম; ওখানে গিয়েও কম্পানি আবার টেস্ট করালো। কেউ তো বলল না, আমি মাদকাসক্ত। আর সারা দিন কাজ করে মরি; পকেটে টাকা নাই; পেটে খাবার নাই; হাতে পাসপোর্ট নাই; আমি মেয়েদের সঙ্গে ফুর্তি করব কী করে?’
‘আসলে দুই বছর কাজ করেছি পিএসএলে; প্রথম থেকেই বেতনের টাকা কাটে। সবাই মুখ বুজে সহ্য করলেও আমি মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করতাম। এটাই আমার বিপদ ডেকে এনেছে।’
জিদানের ভাই না থাকার কথা পিএসএল পরিচালককে জানালে এবার তিনি নিরুত্তর থাকেন।
NB:This post is copied from kalerkantho
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা