ফজলুল বারী : সিঙ্গাপুরের সেই বাংলাদেশি আপনাকে বলছি। আপনাকে চিনি না জানিনা। কিন্তু আপনার কথা শুনে চোখে পানি চলে এসেছে। একটি স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্নে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থায় পড়াটা কারোরই কাম্য নয়। বুধবার আপনার কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিভিয়ান বালাকৃষ্ণান বুধবার আপনার কথা ফোনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।
সেখানকার আইসিইউতে গত ১৩ দিন ধরে আপনি গভীর ঘুমে। মঙ্গলবার থেকে আপনি চিকিৎসকদের সাড়া দিচ্ছেননা। ওষুধও কাজে লাগছেনা। আপনার অবস্থা আশংকাজনক বলে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বাংলাদেশি প্রতিপক্ষকে ফোনে আপনার কথা জানিয়েছেন। আমরা শুধু জানি আপনার বয়স ৩৯। এরবেশি কিছু জানিনা। জানতেও চাইনা। শুধু ধারনা করতে পারি আপনি বিবাহিত। দেশে সম্ভবত আপনার স্ত্রী-সন্তান আছেন। বাবা-মা স্বজনও থাকতে পারেন। তারা নিশ্চয় আপনার অবস্থা জানেন। তারা নিশ্চয় আপনার জন্যে সারাক্ষন কাঁদেন আর দোয়া করেন আপনি যাতে সুস্থ হয়ে যান। এই প্রার্থনা আমরাও করছি। যদিও আপনার যে পর্যায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আপনার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে, ধারনা করা হচ্ছে অলৌকিক কোন ঘটনা ছাড়া আপনি হয়তো আর ফিরবেননা।
সিঙ্গাপুরের এই বাংলাদেশি গত ৯ ফেব্রুয়ারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। সিঙ্গাপুরে এমন মরার রোগে আক্রান্ত পাঁচ বাংলাদেশির চিকিৎসা চলছে। পেশায় এরা সবাই নির্মান শ্রমিক। এবং এরা সবাই সিঙ্গাপুরের একই এলাকায় থাকতেন। খুব ছোট একটি দেশ সিঙ্গাপুর। কিন্তু সবকিছু সাজানো গোছানো ছবির মতোন।
বাংলাদেশের অনেক শ্রমিকের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেশাজীবী দেশটায় কাজ করেন। চীনের সঙ্গে দেশটার নাড়ির সম্পর্ক। সিঙ্গাপুরের জাদুঘর সান্তোসায় চীনের সঙ্গে দেশটির নাড়ির সম্পর্ক কিছু ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
একসময় চীনারা শ্রমিকের বেশে সিঙ্গাপুর এসেছিল। সেই চীনারা এখন সিঙ্গাপুরের নেতৃত্বের অংশীদার। আর শ্রমিক হয়ে গেছি আমরা বাংলাদেশিরা! আবার বাংলাদেশের বড়লোক, টাকাওয়ালাদের চিকিৎসা সহ নানান দাপটের গন্তব্য সিঙ্গাপুর। চীনাদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে করোনা ভাইরাসও এসে পৌঁছে গেছে সিঙ্গাপুর।
দেশটার উন্নত বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছে আক্রান্তদের। বাট লাভ ইন সিঙ্গাপুর প্যানিক ইন বাংলাদেশ!
চীনে জানুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা সম্প্রসারনের পর বুধবার পর্যন্ত এর শিকার হয়ে প্রান হারিয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত ৭৪ হাজারের বেশি। বুধবার চীন এই রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরনকারীদের বিষয়ে বিশেষ একটি তথ্য দিয়েছে। তাহলো এই রোগে আক্রান্ত-মৃত্যুবরনকারীদের বয়স মূলত তিরিশ থেকে উন আশি।
বাচ্চারা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কম। এই জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সংযোগ থাকায় বয়স্করা এতে কাবু হচ্ছেন বেশি। পুরুষরা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চীনারা যেহেতু কাঁচা মাছ-মাংসও খান সেখান থেকে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের চায়না টাউনে খাঁচার মধ্যে বসে থাকা বানর দেখিয়ে ট্যুর গাইড আমাকে বলেছিল, শুধু বলে দেবেন কী রকম খেতে পছন্দ করেন! রোষ্ট না অল্প সেদ্ধ! না শুধু স্মোক করানো!
কাঁচা মাছ-মাংস শুধু চীনারা নয়, বিশ্বের অনেক দেশের লোকজনও খান। এখন করোনা ভাইরাসের কারনে সব কথা হচ্ছে চীনাদের নিয়ে। বাংলাদেশে এক সময় কলেরার গ্রাম ঘিরে আলাদা পতাকা থাকতো। চীন যেন এখন এ যুগের কলেরার গ্রাম!
কারন এখন পর্যন্ত বিশ্বের যে ২৪ টি দেশে এই ভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে তাদের ক্যারিয়ার মূলত চীনের উহান থেকে আসা লোকজন। বাংলাদেশ নিজস্ব নানা সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি ভালো সামাল দিচ্ছে।
বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সব্রিনার সংবাদ সম্মেলন খুব ভালো হচ্ছে। চমৎকারভাবে প্রতিটি প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে তাঁর প্রতিটি ব্রিফিং’এ। যে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে এমন মিডিয়া ব্রিফিং খুবই গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু আমার ভয় অন্যখানে।
আমাদের সব ম্যানপাওয়ার দক্ষ নন। কোথাও কারও অদক্ষতা-খামখেয়ালিপনায় কোন একজন রোগী দেশে ঢুকে পড়লে এই জনবহুল দেশে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবেনা। তেমনটি না হোক সে প্রার্থনা সবার। সতর্কতা আরও বাড়াতে হবে। সাবধানের মার নেই।
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় একটি হুমকির সৃষ্টি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ এ পরিস্থিতিতে কাঁপছে। বাংলাদেশ কী করে পরিস্থিতি সামাল দেবে তা স্পষ্ট নয়।
দাবানলের বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত দেশ অস্ট্রেলিয়া যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করছিল, করোনা ভাইরাস তাতে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’র মতো হয়ে আঘাত হেনেছে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বিদেশি ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসেন বলে এই সেক্টরটিতে বছরে সাত বিলিয়ন ডলারের লেনদেন হয়।
এই বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগ চীনা ছাত্রছাত্রী। করোনা ভাইরাসের কারনে নানান প্রতিষ্ঠানের সময়সূচির গড়বড় ঘটে গেছে। নতুন ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে পারছেননা। পুরনো চীনা ছাত্রছাত্রী যারা চীনা নববর্ষে বাড়ি গিয়েছিলেন তাদের সিংহভাগ এখনও ফেরেননি। তারা এখন ফিরে আসুক তা তাদের সহপাঠীরাও চাইছেননা। চীনের সঙ্গে এখনও অস্ট্রেলিয়ার ভ্রমন নিষিদ্ধ নীতি চলছে।
এদেশের নানান পণ্য চীন থেকে আসে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক যাদেরকে উহান থেকে আনা হয়েছিল তাদের কোয়ারেনটাইন সময় পার করতে হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ক্রিসমাস আইল্যান্ডে।
এখন যাদের আনা হচ্ছে তাদের কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হচ্ছে ডারউইনের পরিত্যক্ত খনি ক্যাম্প এলাকায়। জাপানের প্রমোদতরী থেকে উদ্ধারকৃত অস্ট্রেলিয়ানদেরও নেয়া হচ্ছে ডারউইনে। বাংলাদেশের লোকজনও উহান থেকে ফিরতে চান। কিন্তু সামাজিক কারনে আগে যারা ফিরেছেন তাদের হালসাকিনও গোপন রাখতে হয়েছে।
# লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা