ফজলুল বারী
চীন থেকে প্রকাশিত এবং ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব আশংকায় গোটা বিশ্ব এখন সন্ত্রস্ত। চীনা জিনিসপত্র ভালোনা, টিকবেনা এমন উন্নাসিক লোকজনও এখন মানছেন এই ভাইরাস বিপদজ্জনক। বলা হচ্ছে এই ভাইরাসের সঠিক চিকিৎসা নেই। কিন্তু নিউমোনিয়া আর শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা দিয়ে এই রোগীকে সুস্থ করা হচ্ছে। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ছড়ালেও এতে মৃত্যু ঝুঁকি মাত্র ২ ভাগ। কিন্তু দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়া এই রোগে মৃত্যুর মূল কারন। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দূর্বল। বিমান বন্দরে জোড়াতালির স্ক্যানিং ব্যবস্থা চালু হলে স্থলবন্দরসমূহে কপালে হাত লাগিয়ে জ্বর মাপা হচ্ছে! অথচ এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীও আক্রান্ত হতে পারেন।
অতঃপর করোনা ভাইরাস উদ্বেগের মধ্যে দেশের হাসপাতালগুলোতে কোয়ারেন্টাইন এলাকায় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়া হয়েছে! এরমানে দাঁড়ায় এতোদিন এটা ছাড়াই হাসপাতাল চলছিল! যেখানে সরকারি হাসপাতালে মেঝেতে, বারান্দায় রোগী রেখে চিকিৎসা চলে সেখানে হাসপাতালগুলোতে পৃথক কোয়ারেন্টাইন এলাকা থাকবে এমন ভাবনা-প্রত্যাশাও যেন একটু বাড়াবাড়ি আর কি! চীন থেকে বিশেষ বিমানে করে আনা প্রবাসীদের হজ ক্যাম্পে একই কক্ষে যেভাবে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে এটা কোয়ারেন্টাইনের কোন স্টাইল? ঢাকা সিটি নির্বাচনে ডক্টর কামাল হোসেনের ভোট দেবার সময় আমরা চিহ্নিত করতে পারি বয়স্ক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী লোকজনের বাংলাদেশে ভোট দেয়াও কঠিন। স্কুল-কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশে ভোটকেন্দ্র করা হয়। কিন্তু এসব ভবন নির্মানের সময় হুইল চেয়ার নিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থাটি সবক্ষেত্রে রাখা হয়না। শুধু ভোট দেবার সময় নয়
অথচ সভ্য উন্নত বিশ্বে যে কোন ভবন বিশেষ করে যেখানে মানুষের ব্যাপক যাতায়াত আছে এমন ভবন-শপিংমল সবখানেই বাধ্যতামূলক হুইল চেয়ার একসেস থাকতে হয়। এসব নিশ্চিত করা হয় নির্মানের সময়েই। বাস-ট্রেন সব এমনভাবে নকশা-তৈরি যাতে একজন হুইল চেয়ারধারী ব্যক্তি নিরাপদে সেটিতে চড়তে বা নামতে পারেন। রেল স্টেশনের স্টেশন মাষ্টার বা বাসের চালক এমন যাত্রীর নিরাপদ উঠানামায় সহায়তা করেন। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোথাও যেতে সংশ্লিষ্ট রেল স্টেশনের স্টেশন মাষ্টারকে ফোন করলে তিনি তার জন্যে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। এমন যাত্রী দেখলে বাস চালক প্রয়োজনে আসন থেকে উঠে তাকে বাসে চড়তে, প্রতিবন্ধী যাত্রীদের আসনে তাকে বসাতে সহায়তা করেন। যাত্রী নামার সময়ও একই সহায়তা করেন বাস চালক। উল্লেখ্য এসব বাসে কোন সহকারী বা হেলপার থাকেনা। বেশিরভাগ স্টেশনে স্টাফও মাত্র একজন। তিনি স্টেশন মাষ্টার। তিনি স্টেশন ঝাড়ুও দেন। যাত্রী সেবার এসব দায়িত্বও পালন করেন।
শুধু এসব নয়, বানিজ্যিক ভবন নির্মানের সময় এর চালাটি এমন ছাউনির মতো বিস্তৃত করে বানাতে হয় যাতে বৃষ্টির সময় মানুষজন আশ্রয় নিতে পারেন অথবা এর নিচ দিয়ে নিরাপদে চলাচল করতে পারেন। এসব কিন্তু দয়া নয়। মানুষের অধিকার। এমন নানা ঘটনায় বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের নানা অপ্রাপ্তি জোড়াতালি প্রকাশ পায়। ১৯৯৩ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে দেখেছি ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াই লাল সবুজ বাতি দেখে গাড়ি থামে গাড়ি চলে, কিন্তু বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত সে ব্যবস্থাটিও নিশ্চিত করতে পারেনি।
আমাদের এখানে প্রতিটি বাড়িতেই টয়লেট-বাথরূম-রান্নাঘরে ঠান্ডা পানির সঙ্গে গরম পানির ব্যবস্থা আছে। সাদ্দাম হোসেনের পতনের সময় ইরাকে গিয়েও দেখেছি এটা কোন বিলাসিতা নয়, জীবনের প্রয়োজন। শপিংমল-হাসপাতাল-রেল স্টেশন-পাবলিক টয়লেট সব জায়গাতেই ভবন নির্মানের সময়ই এসবের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের কয়টা বাড়িতে এ ব্যবস্থা আছে বা নির্মানের সময় ভাবা হয়? বাংলাদেশ উন্নত দেশ হতে চায়। এটা সম্ভব। কিন্তু এর আগে জনগনের জীবনমান উন্নত করতে হবে। উন্নত দেশ মানে শুধু চার-ছয় লেনের সড়ক, উড়াল সেতু আর পদ্মা সেতু নয়। উন্নত জীবন মানে সব মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক উন্নত জীবন নিশ্চিত করা।
এই কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ডেঙ্গু জ্বর-এডিসমশা নিয়ে রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষ সবার অসহায়ত্ব দেখেছে। করোনা ভাইরাস আতঙ্ক সৃষ্টির পর জানা গেলো বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য-অবকাঠামোই নেই। বাংলাদেশ এরমাঝে বিশেষ বিমানে করে উহান থেকে প্রবাসীদের বড়সড় একটি দলকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। নগদ টাকা বাঁচাতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিমানকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ওই ফ্লাইটের পাইলট-ক্রুদের এরপর অন্য দেশ ঢুকতে দিচ্ছেনা দেখে বাকি নাগরিকদের আনতে ভাড়া বিমান খোঁজা হচ্ছে। উল্লেখ্য উহানে আজ চাইলে কালই নাগরিকদের নিয়ে আসতে পারেনা কোন দেশ। এ ব্যাপারে সেখানকার বিমান বন্দরের স্লট পাবার উপর নির্ভর করে পুরো কার্যক্রম। কিন্তু নাগরিকদের নিয়ে আসা, বিমান বন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা মানে করোনা ভাইরাসের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া বলেনা।
বাংলাদেশে এখনও কোন করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত না হলে এখানে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার মতো অবকাঠামো আছে। কারন চীন থেকে ভারত থেকে বিস্তর লোকজন এখানে প্রতিদিন আসা যাওয়া করেন। এখানে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি, কারন স্বাস্থ্য কর্মীদের অনেকে সে রকম দক্ষ নন। নিজেদের কাজের ব্যাপারে আন্তরিক নন। শহর, জীবনযাপনের ব্যবস্থাটি সাফসুতরো গোছানো নয়। নোংরা। ডেঙ্গুর সময় আমরা দেখেছি হাসপাতালের ভেতরেই, কথিত ভদ্রলোকদের বাড়িঘরেই এর বিস্তারের সূতিকাগার। কাজেই করোনা বিপদ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে চাইলে শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা, সবার ঘরবাড়ি-জীবনযাপন পরিচ্ছন্ন-স্বাস্থ্যসম্মত করতে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু বস্তি নয়, গরিব মানুষজনের জীবনযাপনেইতো পরিবেশ-পরিচ্ছন্নতার মা-বাপ নেই! বাংলাদেশের কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজারগুলোও খুবই নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। সে কারনে ভয় করছে, এই রোগ এখানে শনাক্ত হলে দ্রুত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে সবখানে। সাবধান বাংলাদেশ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা