প্রতি রবিবার তাঁর বাড়ির সামনে ভিখারিদের লাইন পড়ে যায়। সংখ্যাটা কম করেও হাজার। রান্নার আয়োজন সারা থাকে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই। তাঁর নিজের আশ্রম ‘নিঝল মাইয়াম’-এর বাসিন্দাদের জন্যও সেদিন ভোজের ব্যবস্থা। ভিখারিদের পাত পেড়ে খাইয়ে, বাকি খাবার চলে যায় আরও ছ’টি আশ্রমে। অনাথ শিশুদের জন্য ঝাল কম দিয়ে সাম্বার ডাল আর ভাত তৈরি করেন নিজের হাতে। এভাবে চলছে বছরের পর বছর।
তিনি পেশায় একজন অটোচালক। দিনভর চেন্নাইয়ের অলিতে গলিতে অটো চালিয়ে মাসে রোজগার হাজার তিনেক। এ ছাড়া আরও কিছু টুকটাক কাজ। তাতেও আয় খুব বেশি নয়। অথচ মাসে অভাবী, অভুক্তদের মুখে অন্ন তুলে দিতে খরচ হয় ২০ হাজার টাকারও বেশি। তারপরে নিজের আশ্রমের খরচ তো রয়েছেই। সেখানেও ঠাঁই মিলেছে নিজের বাড়ি থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে গৃহহীন ভিখারিদের।
নাম তার মুরুগান। নামটা হয়তো জানেন না অধিকাংশ চেন্নাইবাসীই, কারণ প্রচারের আলো ছাড়াই নিঃস্বার্থভাবে মানবতার কাজ করছেন মুরুগান। নাম না জানা, অপরিচিত, অভাবী ধুঁকতে থাকা মানুষগুলোকে নিয়েই স্বপ্ন সাজাতে ভালোবাসেন মুরুগান। তাঁর যাপন-চাহিদা খুবই কম, কিন্তু লক্ষ্যটা এক আকাশ বড়।
শুরুটা ঠিক এমন ছিল না। আলোর পথের আগে অন্ধকারটা ছিল বড়ই গাঢ়। তারই বিবরণ দিতে গিয়ে মুরুগান জানান, সালটা ছিল ১৯৯২। দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় ফেল করার পরে পড়াশোনায় ইতি টেনে দেয় বাড়ির লোকজন। মানসিক অবসাদ এমন চরম সীমায় পৌঁছায় যে জীবন শেষ করে দেওয়ার সংকল্প নেয় কিশোর ছেলেটি। টিফিনের খরচ বাঁচানো ৩০০ টাকা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে পালিয়ে বাসে চেপে বসেন মুরুগান। উদ্দেশ্য বাস যেখানে থামবে, সেখানে নেমেই আত্মহত্যা করবেন তিনি।
বাস পৌঁছায় কোয়েম্বত্তূরের সিরুমুগাইতে। স্থানটি চেন্নাইয়ে তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তখন মধ্যরাত। রাস্তার ফুটপাথেই আশ্রয় নিতে হয়। বাড়ির নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সম্পূর্ণ অপিরিচিত জায়গায় পৌঁছে এক অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে ওঠে। কোথায় যাওয়া যায় ভাবছেন মুরুগান, ঠিক তখনই মাথায় স্নেহের হাত রাখেন এক বৃদ্ধ। ছেঁড়াফাটা জামা, লুঙ্গি, কাঁধে একটা ঝোলা।
মুরুগানের কথায়, পরে জানতে পারি ওই বৃদ্ধ ছিলেন একজন মুচি। সেদিন রাতে আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর ঝুপড়ি ঘরে। সারারাত মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
শুধু সেই বৃদ্ধ নয়, তাঁকে আশ্রয় দিতে এগিয়ে এসেছিলেন আরও অনেক আশ্রয়হীনেরা। মুরুগান বলেছেন, সেই ফুটপাথে অনেক মানুষ শুয়েছিলেন। তাঁদের নিজেদেরই কোনও ঠিকানা ছিল না। জমিয়ে রাখা খাবার থেকে আমাকে খেতে দিয়েছিলেন। অভাবী মানুষগুলোর আতিথেয়তা দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এমনও হয়! আমার আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা তাঁরাই বানচাল করে দিয়েছিলেন।
পরদিন সকালে ভিখারিরাই টাকা জোগাড় করে বাসের টিকিট কেটে মুরুগানকে তাঁর বাড়িতে ফেরত পাঠান।
কিশোর বয়সের সেই অভিজ্ঞতার শেষ হয়তো সেখানেই হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কারণ নিরাশ্রয়দের আশ্রয় দেওয়ার একটা বৃহত্তর পরিকল্পনা নিজের মনেই সাজিয়ে নিয়েছিলেন মুরুগান। তাকেই বাস্তব রূপ দিতে, শুরু হয় তাঁর অভিযাত্রা।
তিনি জানিয়েছেন, পড়াশোনা আর সেভাবে হয়নি। হোটেলে-রেস্তোরাঁয় কাজ করেছেন। বাসন ধুয়েছেন, খাবার পরিবেশন করেছেন।
তিনি বলেন, যেসব হোটেলে কাজ করেছি সেখানে ভোর ৪ টায় উঠতে হতো। সাফাইয়ের কাজ সেরে রান্নার জোগাড় করতে হতো। তিন বেলা খাবার পেতাম, আর মাইনে। টাকাটা জমিয়ে রাখতাম।
মুরুগান জানান, ছয় মাস এভাবে চলে গেল। তারপর আবার নতুন কাজ। বাড়িতে বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি। নিজের জন্য সামান্য টাকা রেখে, পুরোটাই জমিয়ে রাখতেন। এরপর একদিন অটোর স্টিয়ারিং উঠল হাতে। সালটা ২০০৬। এক সংস্থার অধীনে কয়েকটি রুটে অটো চালানোর কাজ। ড্রাইভিং লাইসেন্স জুটিয়ে দিয়েছে তারাই। শুরু হলো এক নতুন পথ চলা। মাসে তিন হাজার টাকা রোজগার।
দু’বছরে যা টাকা জমল তা দিয়ে ২০০৮ সালে খুলে ফেললেন ‘নিঝল মাইয়াম।’ একজন, দু’জন করে গৃহহীনদের নিয়ে আসতে লাগলেন নিজের আশ্রমে। সিরুমুগাইয়ের সেই ফুটপাথ থেকেও নিয়ে এলেন অনেককে। মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুরাও আশ্রয় পেতে শুরু করল তাঁর আশ্রমে। বাড়তে লাগল মুরুগানের পরিবার।
তিনি বলেন, একাই শুরু করেছিলাম। কীভাবে খরচ চালাবো জানতাম না, মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আরও ছয় বন্ধু যোগ দেন আমার সঙ্গে। তাঁরাও টাকা জোগাড় করে আনতেন।
মুরুগান বলেছেন, এখন এলাকার অনেক সহৃদয় ব্যক্তি আমাদের অনুদান দেন। আরও ২৫টা আশ্রমের সঙ্গে আমরা যুক্ত। সেখানকার মানুষজনেরও সেবা করি। জীব সেবাই আমাদের ধর্ম।
প্রতি শনিবার বাজারের কাজ সেরে রাখেন মুরুগান ও তাঁর স্ত্রী। ভাত, সাম্বর ডাল আর এক রকম সবজি। রবিবার সকাল থেকে ভিখারিদের লাইন শুরু হয়ে যায়। সারা সপ্তাহের জমানো টাকা থেকেই রবিবারের এই বিশেষ ভোজ। শুরুটা হয়েছিল ১০০ জন দিয়ে। এখন সংখ্যাটা হাজার ছাড়িয়েছে। আশ্রয়দাতা সেদিনের সেই বৃদ্ধ মুচি আজ আর বেঁচে নেই, তবে তাঁরই মতো শত শত অভাবী মানুষের পেটের জ্বালা মেটান মুরুগান।
দুঃস্থ শিশুদের নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেন আর বলেন, কখনও আত্মহত্যার চেষ্টা করো না। জীবন অনেক বড়। এগিয়ে যাও, হয়তো একদিন আমারই মতো লক্ষ্য খুঁজে পাবে।
সূত্র : দ্য ওয়াল
NB:This post is copied from kalerkantho
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা