আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
আসলে একাত্তর সালের সময়টা মুখের কথায় বর্ণনা করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ এর মধ্যে ৪৮ টা বছর পার হয়ে গেছে। ৪৮ বছরে দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আর্থ-সামাজিক সব দিকেই পরিবর্তনগুলো হয়েছে। তখন আমাদের দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন সেখানে ১৭ কোটি বলা হয়। সেই সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্য থেকে কিন্তু অত্যন্ত অল্প একটা অংশ, যাদেরকে অগ্রসরগামী অংশ বলা হয়। সবমিলিয়ে এক লাখ ত্রিশ-৩৫ হাজার হবে। তাা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে।
একাত্তরের সালের যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন ছিল এখন সেটা কল্পনাও করা যায় না। তখন এখন যেরকম যোগাযোগ মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তখন সেটা ছিলনা। পথঘাট এরকম ছিলনা। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এইরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে যেতে হয়েছে। যুদ্ধ করতে হয়েছে। একাত্তরে সালে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম তারা আসলে এমন চিন্তা ভাবনা ভেবে করি নাই যে, আমরা ফিরে আসব।
জীবন বাজি রেখেই আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। তবে, একটা জিনিস আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা যারা সচেতন ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম তাদের ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে। দীর্ঘায়িত হলে, যেটা হওয়ার কথা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তো আমাদের একটা স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন না থাকলে আমরা যুদ্ধে গিয়েছি কেন? আমাদের যে স্বপ্ন ছিল সেটা হলো, আমরা যুদ্ধ করে যে দেশটা নিয়ে আসব, যে দেশটা স্বাধীন হবে, সেখানে কোন বৈষম্য থাকবেনা। সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
অর্থনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন যেটা পাকিস্তান আমলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা যারা ভুক্তভোগী সে ধরণের কোন শোষণ নিপীড়ন থাকবে না। রাজনৈতিক নিপীড়ন থাকবে না। একটা সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বলতে যেটা হয়। সেটা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি যে, আমাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু এই বিজয় দিবসে আমরা যেটা বলছি, ১৬ ই ডিসেম্বর। একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়া শুরু হয়েছে। আমরা অত্যন্ত বেদনা নিয়ে এটা প্রত্যক্ষ করেছি।
গত ৪৮ বছর ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বলা হয়ে থাকে, ১৯৭১ সালে ধনী গরীবের যে বৈষম্য ছিল তাদের মধ্যে যে বৈষম্যটা ছিল সেটা এখন শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলা যেতে পারে। সেই অর্থে বিজয় দিবস আসলে আমাদের মধ্যে এক ধরণের আত্মগ্লানিও আমাদের মধ্যে আসে। যে, আমরা এই দেশের জন্যই কি যুদ্ধ করেছিলাম!
আমরা আমাদের কোন স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন দেখছিনা। অথচ সেদিন কি নির্বোধের মতো কোন কাজ করেছিলাম কিনা এই ধরণের প্রশ্ন অনেক মুক্তিযোদ্ধা করে থাকেন। ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ আমরা আমাদের নিজ এলাকাতে ছিলাম। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। সেখানে আমরা ছিলাম। তখন আমাদের কাছে কিন্তু বিশেষ করে ঈশ্বরদী এলাকার যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের কাছে ১৬ই ডিসেম্বরের আলাদা কোন তাৎর্পয্য সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। সেদিন সেখানে হাজার হাজার অবাঙালি ছিল। ফলে, বাংলাদেশের সব যায়গার মতো ঈশ্বরদীতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়নি। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়নি।
ঈশ্বরদীর মুক্তিযুদ্ধের কতগুলো দিক আছে। যে রকম আমরা ঈশ্বরদীতে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তিনটা পর্যায়ে এটাকে মোটা দাগে ভাগ করা যায়। ১টা হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন ( ১ লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন)। আন্দােলনের মধ্যে আমাদের যুদ্ধ প্রস্তৃতিটা ছিল। স্কুলের মাঠগুলােতে শারীরিক কুচকাওয়াজ এগুলাের মাধ্যমে তরুণ যুবকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে তাদের মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত করে তোলা – এই ব্যবস্থাগুলো তখন আমরা নিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর থেকে ১১ ই এপ্রিল। এই সময়টা ছিল ঈশ্বরদীর জন্য একটা গৌরবোজ্জ্বল একটা অধ্যায়। এই সময়টা আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ টা কাদের বিরুদ্ধে। এটা হচ্ছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা তখন আগ্রাসন চালাচ্ছিল বিভিন্ন দিক থেকে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরােধ যুদ্ধ ছিল।
এই প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা ১লা এপ্রিল ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সিগন্যাল কােরের একটি ইউনিট ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টে অবস্থান করছিল। তাদেরকে আমরা কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র করি। তাদেরকে গ্রেফতার করতে সক্শত হই। এরপরে যে বড় যুদ্ধ হয়েছিল ২৯ শে মার্চ। এদিন পাবনা থেকে প্রায় ৬০-৭০ জনের একটা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কনভয় ৬-৭ টা গাড়ি নিয়ে তারা পাবনা থেকে ঈশ্বরদী হয়ে রাজশাহী যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
তখন পাবনা এবং ঈশ্বরদী সীমান্তে মাগপুর বলে একটা জায়গা আছে সেই মাগপুরে তাদেরকে প্রতিরোধ করা হয়। হাজার হাজার জনতা সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশহগ্রহণ করে যাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিলনা। অস্ত্র বলতে আমাদের ছিল কিছু একনলা, দোনলা রাইফেল, কিছু টুটো রাইফেল, আর ছোট রাইফেল- এগুলো সব মিলিয়ে ২০-২২ টার বেশি হবে না। সেগুলাে নিয়েই কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা হয়। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা ছিল যুদ্ধ সাজে। তাদের কাছে সয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল।
সেগুলো দিয়ে তারা নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে। ফলে সেখানে নয়জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়। পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের পুরো এলাকা অধিকৃত করে নেয়। ঈশ্বরদী অধিকৃত করে নেয়। তারপরে কিন্তু আমাদের মূল মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়। তখন আমরা অধিকাংশ ছাত্র, যুবক তরুণ, যারা আগে থেকে সংগঠিত হচ্ছিলাম, যারা বিভিন্নভাবে নিজেদের সংগঠিত করছিলাম তারা সব ভারতে গিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা আবার দেশে ফিরে বিভিন্ন গেরিলা অপারেশণ এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে আমরা অংশগ্রহণ করি। সেখানে বিহারি যারা ছিল হাজার হাজার বিহারি, অবাঙালি যারা ছিল তাদেরকে কিন্তু দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী সশস্ত্র করে তুলেছিল।
তারা আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল এবং তারা নির্বিচারে সেখানে হাজার হাজার বাঙালি পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। হাজার হাজার বাঙালিকে তারা নিহত করেছে এবং বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এই বিহারিদের হাতে প্রচুর সংখ্যক অস্ত্র থাকায় একদিকে আর একদিকে হলো ঈশ্বরদীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩রা ডিসেম্বরের পরেই অর্থাৎ পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে তারা ঈশ্বরদীতে অবস্থান করছিল।
সেখানে ১৬ই ডিসেম্বরের পরে এক পর্যায়ে তাদের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ৫ হাজারের উপরে। তো এই কারণে ১৬ ই ডিসেম্বরে কিন্তু ঈশ্বরদী শত্রুমুক্ত হয়নি। শত্রুমুক্ত হয়নি, আমরাও কিন্তু ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত হই নি এই কারণে যে, যাতে অযথা যেন ক্ষয়ক্ষতি না হয়। কারণ ১৬ ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করছে। তো, আমরা তাদের সঙ্গে যখন কথাবার্তা বলি তখণ তারা বলেছে, যে আমরা আত্মসমর্পনে রাজি আছি। তবে, ভারতীয় বাহিনী আসার পরে। তারা এডামেন্ট ছিল যে, ভারতীয় বাহিনী ছাড়া তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।
সেই অবস্থায় যদি আমরা আত্মসমর্পণে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতাম তাহলে বহু হানাহানি হতো দুইপক্ষে। আমরা এটা এড়ানোর জন্য যেহেতু তারা আগেই সারেন্ডার করে গেছে ঢাকাতে, এটা এড়ানোর জন্য আমরা ১৬ই ডিসেম্বরে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইনি। ১৬ ই ডিসেম্বর ঈশ্বরদী শত্রুমুক্তও হয়নি। এটা ১৯শে ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী আসার পরে ২১ শে ডিসেম্বর সেখানে আত্মসমর্পণের দলিলটা স্বাক্ষরিত হয় ওখানে। সুতরাং ২১ শে ডিসেম্বর ঈশ্বরদী পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। সুতরাং ঈশ্বরদীয় বিজয় হলো আসলে ১৯ শে ডিসেম্বর ও ২১ শে ডিসেম্বর ১৬ই ডিসেম্বর নয়।
# সাধারণ সম্পাদক, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
# সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লাল সবুজের কথা ডটকম।
আরও পড়ুন : রাজাকার যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তখন খুব খারাপ লাগে : আব্দুস সামাদ তালুকদার
আরও পড়ুন : রক্ত স্রোতে পবিত্র হয়ে জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতির স্বাধীন বাসভূমি বাংলাদেশ : ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ
আরও পড়ুন : আমাদের মতো মানুষের কাছে একাত্তরের স্মৃতি বিবিধ : আফসান চৌধুরী
আরও পড়ুন : একদিকে বিজয়ের উল্লাস, অন্যদিকে প্রিয় দুই শিক্ষকের মৃত্যু আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল : ডা. মাগদুমা নার্গিস রত্না
আরও পড়ুন : রেডিওতে পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর শুনে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই : সাইফুল ইসলাম
লালসবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা