আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
১৯৬৮’র শেষের দিকে -১৯৬৯ এর শুরুতে ছাত্র সমাজের আইউব বিরোধী ১১ দফার আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। ‘৬৯ এর জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখ আসাদের শহীদ হওয়ার পর মুহূর্তে থেকেই বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন হয়ে উঠে চরম বেগবান। ২০ তারিখ বিকেল ইডেন কলেজের মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে আসে সাদা শাড়ি আর কালো পতাকা হাতে । তখনকার দিনে সে এক অন্যরকম দৃশ্য !
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছিলো । ২৪ জানুয়ারি ঢাকা হয়ে উঠে মিছিলের শহর । এটাই ’৬৯ এর মহান গণ অভ্যুত্থানের ইতিহাস। এরপর ৬৯ এর প্রতিটি দিন – সপ্তাহ কাটে চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এবং ২৫ মার্চ ১৯৬৯ আইউবের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসে জেনারেল ইয়াহিয়া। ক্ষমতায় এসেই ইয়াহিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে জারি করেন LFO (Legal Frame Order) – যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ বিধি বেঁধে দেন । তবে উনি পরিস্কার ঘোষণা দেন যে নির্বাচন এক লোক এক ভোট এর নীতিতে হবে এবং অক্টোবর ১৯৭০ এ জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। জানুয়ারি ১ , ১৯৭০ থেকে নির্বাচনের জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেন। পরে ৭০’র আগস্টে পূর্ববাংলায় বন্যার কারনে – জাতীয় নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক নির্বাচন ১৭ ডিসেম্বর নির্ধারিত হয় ।তখন অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও মাওলানা ভাসানির ন্যাপের নেতৃত্বে কিছু চীনা পন্থী দল “ভোটের বাক্সে লাথি মারো – আন্দোলনের পথ ধর” –শ্লোগান তুলে নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। তাদের ভিতর আজকের রাশেদ খান মেননরা ও ছিল।
বঙ্গবন্ধুর মিছিল এবং মিটিং সব সময় থাকতো লোকে লোকারণ্য । সে কি সমাবেশ! অন্য কোন রাজনৈতিক দল তার ধার কাছ দিয়েও ছিল না।
এরই মধ্যে ১৯৭০ এর নভেম্বরে পূর্ব বাংলার নোয়াখালী, হাতিয়া, মনপুরা, ভোলা সহ কয়েক জেলায় ঘটে যায় ভয়াল জলচ্ছাস। কেন্দ্রীয় সরকার আবারও নির্বাচন পেছানোর কথা তোলার চেস্টা করলে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে দুর্গত এলাকার জাতীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনী এলাকা সমূহের নির্বাচন আপাতত স্থগিত করে অন্যান্য নির্বাচনী এলাকা সমূহে ভোট গ্রহণ হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে সর্বমোট ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টা আসনের ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে জয়লাভ করে। একটি মাত্র আসনে জয়লাভ করে কুড়েঘর মার্কার সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। রেজাল্ট দেখে সবাই চমকে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠেন পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র নেতা।
পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার পিলে চমকে যায়। শুরু হয়, বাঙালিদের অলপাকিস্তানের ক্ষমতায় বসতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র । বাংলার মানুষ একাট্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ায়। শুরু হয় পূর্ব বাংলার বাঙালির জীবনের আরেক অধ্যায়।
না না ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়ে আসে ১ মার্চ ১৯৭১। পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কফিনে শেষ পেরেকটি গুঁজে দেয়। স্থগিত করে ৩রা মার্চের আহ্বানকৃত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন । সারা বাংলা গর্জে উঠে একসাথে – একটি শ্লোগানকে মুখে নিয়ে – বীর বাঙালী অস্ত্র ধর , বাংলাদেশ স্বাধীন কর। জয় বাংলা।
আসে ৭ মার্চ – রবিবার – বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রচিত হয় স্বাধীনতার মহাকাব্য। ৭১ এর উত্তাল মার্চ – আহ কি সুখের আর আনন্দের – প্রতিদিন – প্রতিক্ষণ – দেশ এগুচ্ছে নুতন যাত্রার দিকে। এলো ২৫ মার্চ। ভয়াল রাত। আমাদেরকে সন্ধ্যের সময় ক্রাকডাউন হতে পারে বলে মিছিল থেকে বাসায় ফিরে যেতে বলা হয়।
আমি রাত ১১টার দিকে আমার বড় ভাইয়ের জন্য ( যিনি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন লিয়াকত হলে -বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী হলে থাকতেন) রাতের খাবার নিয়ে শেখ সাহেব বাজার থেকে আজিমপুর এতিমখানার পাশ দিয়ে পলাশীর ফায়ার ব্রিগেডের পাশ দিয়ে গিয়ে আর এগুতে পারি নাই – ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে রাখছিল – আর এগুতে না পেরে বাসায় ফিরে সবাইকে সর্বশেষ খবর বললাম। সবাই এক অজানা আশঙ্কায় নিমজ্জিত হলো ।
এলো অপারেশন সার্চ লাইট – ক্রাকডাউন – ইকবাল হলে, জগন্নাথ হলে – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে। কাপ্তান বাজার, শাঁখারী বাজার কোথায় না। আগুনের সে কি লেলিহান শিখা!
২৬ মার্চ সারাদেশে কারফিউ। ২৭ মার্চ সকালের দিকে ৪ ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হোল । আব্বা আর আমি রিক্সা নিয়ে খুজতে বেরুলাম বড় ভাইকে। লালবাগ থেকে আজিমপুর হয়ে পলাশীর ফায়ার ব্রিগেডের পাশ দিয়ে লিয়াকত (সোহরাওয়ার্দী) হল হয়ে ইকবাল হল – এস এম হল – জগন্নাথ হল – শহীদ মিনার- ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ – পল্টন – গুলিস্তান – কাপ্তান বাজার – নওয়াব পুর রোড ধরে শাঁখারী বাজার – ইসলামপুর হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মর্গ হয়ে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউট ডোরে এসে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের দেখা পাই এবং জানতে পারি- বড় এই মাত্র এখান থেকে লালবাগের বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন।
মার্চ – এপ্রিল – মে- গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর । তারপর জুনে ঢাকা ফেরা – পার্টির সাথে যোগাযোগ স্থাপন। ভারতে যাবার প্রস্তাব নাকচ। অবরুদ্ধ ঢাকায় কাজ করতে হবে। শুরু হল – আরেক জীবন।
আগস্টে কাঁঠালবাগান এলাকায় ৮১ জনের মিটিং। ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় স্তালিনগ্রাদের মতো লড়াই হবে – সুতরাং – জনগনের ভিতরে থেকে এ লড়াইয়ে অংশগ্রহন করতে হবে। আমার জন্য দুটি কন্টাক্ট পয়েন্ট দেয়া হল। এর বাইরে কাউকে চিনিও না – জানিও না – রাস্তায় হঠাৎ মুখোমুখি হলে না চেনার ভান করা – ইত্যাদি না না নির্দেশাবলী নিয়ে মিটিং ত্যাগ।
তারপর রেগুলার কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ”প্রতিরোধ” বিশজনকে পড়িয়ে ১০ পয়শা করে দুই টাকা প্রতি সপ্তাহে দুটি কন্টাক্ট পয়েন্টের একটিতে পৌঁছে দেয়া, নুতন নির্দেশ এবং পত্রিকার নুতন কপি গ্রহন করা। জনগণকে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে উদ্ভদ্ধ করা – কমরেডদের চলাচলের জন্য বিশ্বাসযোগ্য ডান্ডি কার্ড তৈরি করা। পারলে পাকিস্তানপন্থী দলের থেকে। আমি পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সবুরখানের স্বাক্ষর করা ১৭টি ডান্ডি কার্ড নিজের একটা সহ যোগাড় করি।
আগস্টের শেষের দিকে প্রায়শই দেখতাম – অনেক যুবক বয়সের ছেলেদের আর্মির ভ্যানে মিরনিয়ে যেত – পরে শুনেছি – রনাঙ্গন থেকে ফেরত আহত পাকিস্তানী সৈনিকদের জন্য রক্তের দরকার পরায় – এ যুবকদের শরীর থেকে সম্পূর্ণ রক্ত বের করে মেরে যত্রতত্র ফেলে যেতো ।
একটা বিষয়ে একদম না বললেই নয় – বাংলাদেশের বহু মায়েরা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের জন্য রোজা রাখতেন। আমার দাদি – মাকে দেখেছি রোজা রাখতে ।
এই আগস্ট মাসেই ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অপারেশন করে ক্রাক প্লাটুন। আগস্ট – সেপ্টেম্বর – অক্টোবর – নভেম্বরের মাঝামাঝি এ ভাবেই চলে। তবে আগস্ট মাসের ৯ তারিখ ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত মৈত্রী ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি আমাদের সবার মনোবল বাড়িয়ে দেয়। এবং সমগ্র যুদ্ধটার একটা আন্তর্জাতিক রূপ দান করে।
যার ফল আমরা দেখতে পেয়েছি – ডিসেম্বর মাসে । যুদ্ধের শেষ কয়েক দিনে।
নভেম্বরের শেষ দিকে এটা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে খুব দ্রুতই যুদ্ধটা পরিসমাপ্তির দিকে যাবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ সে ইঙ্গিতই দিচ্ছিল।
৩রা ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। ইন্দিরা গান্ধী তখন কোলকাতায় ছিলেন। তিনি দ্রুত রাজধানী দিল্লীতে ফিরে – ভারতের সংসদের জরুরী অধিবেশন ডাকার জন্য ভারতের প্রেসিডেন্ট বি ভি গিরিকে অনুরোধ করেন।
৫ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ অধিবেশনে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির মূল উদ্যেশ্য ছিল – যদি ভারতীয় সৈন্য বাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভিযান করে পাক আর্মির সাথে যুদ্ধ করতে হয় – তখন যেন বহিঃ বিশ্ব মনে করে এই অভিযান একটি স্বাধীন দেশের সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে করা হয়েছে।
যদিও আমাদের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র দফতরে ভুটানের স্বীকৃতির ডিক্লারেশন আগে পৌঁছায় – এবং বিশ্ব জানে ভারত নয় – ভুটানই বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে। হয়তো আরও কোন কূটনৈতিক – রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে এর পেছনে।
এবার আসি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক ভাবে থামিয়ে দেয়ার মার্কিন প্রচেস্টার বিষয়ে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এক শক্তি হিসেবে ছিল।
ডিসেম্বরের ৬ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত মোট ৪ বার সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে – যা জাতিসংঘের ইতিহাসে বিরল। এমনকি ডিসেম্বরের ৭/৮ তারিখের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দেশের নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাবার নাম করে ৭ম নৌবহর বঙ্গপসাগরের দিকে রওনা করিয়ে দিয়ে মুক্তিবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার চেস্টা করে ছিল কিন্তু সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার আরো শক্তিশালী নৌবহর দিয়ে আমেরিকার সে প্রচেস্টাও ভেস্তে দেয়।
এর মধ্যে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর আল বদর বাহিনী – বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বেঁছে বেঁছে ধরে নিয়ে গিয়ে হিংস্র হায়েনার মতো হত্যা করে। উদ্যেশ্য ছিল আমাদেরকে মেধা শুন্য করে ফেলা।
এত রক্ত আর এত বেদনার মধ্য দিয়ে জন্ম নিল বাংলাদেশ – ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে অহংকার করার মতো অনেক কিছুই আছে। এ’র মাঝে সবচে’ বড় অহংকার একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। একাত্তরে পাকিস্তানী মিলিটারিও তাদের তাদের সহযোগীরা বাঙালিদের হত্যা করেছে নির্বিচারে; লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। লড়াই করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন জানা অজানা অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা । পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগী রাজাকার আল-বদররা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
রক্ত স্রোতে পবিত্র হয়ে জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতির স্বাধীন বাসভুমি বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির জন্য খুলে দিয়েছে সামনে এগোবার পথ।
আজ আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশায় অনেকেই বড় হয়েছেন – দেশ ও দশের একজন হয়েছেন। কিন্তু তাদের সবাই কি মনে রাখেন – বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এ পর্যন্ত তারা এগোতে পারতেন না – এই সহজ সরল সত্যটি?
আমাদের সুন্দর জীবন উপহার দিতে গিয়ে যে সব শহীদরা তাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ – নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদেরকে ক্ষণিকের জন্য স্মরণ করাটাও এখন একটা বড় ব্যাপার।
# ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী।
# সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লাল সবুজের কথা ডটকম।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা