তাসকিনা ইয়াসমিন
দেশ যখন করোনা ভাইরাসের মতো বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলায় লড়াই করছে ঠিক সেই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতাল, চিকিৎসকদের জন্য আলাদা আলাদা চিঠি ইস্যু হচ্ছে। আবার, একটা চিঠির প্রতিবাদে অন্য আর একটি চিঠি আসছে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা পোশাক এখনো সবার কাছে পৌঁছেনি। এমন পরিস্থিতি আসলে কেন তৈরি হচ্ছে? এই ধরণের পরিস্থিতি চিকিৎসক সমাজের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে এমনটিই মনে করছেন সিনিয়র চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস। তার মতে, এক্ষেত্রে চিকিৎসক সেবাদানকারীসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সবাইকে নিয়ে একটা সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী।
তিনি লাল সবুজের কথা’কে বলেন, একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার প্রথম কথা হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গোপন করার কিছু নেই। তোমার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই করতে হবে। এ লড়াই করতে হবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালারভিত্তিতে। করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক। এটা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে একেবারে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো। সেইক্ষেত্রে লড়াইটা কিন্তু সামগ্রিক। এরসাথে চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোটা জাতি যুক্ত থাকার কথা। সেটা একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালারভিত্তিতে।
প্রথমে মন্ত্রণালয় থেকে এই পত্রটি জারি করা হয়। যা নিয়ে চিকিৎসকদের পক্ষে তুমুল প্রতিবাদ হয়।
তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার আদালত একটি রায় দিয়েছে যে যারা এইসমস্ত রোগীর চিকিৎসা করছে তাদেরকে বীরের মর্যাদা দিতে হবে। পাশাপাশি গতকালকে দুটো পত্র জারি হয়েছে। একটি মন্ত্রণালয় থেকে এবং একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। মন্ত্রণালয় থেকে যেটি জারি হয়েছে – যারা এই ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই এই চিঠিটি লেখা হয়েছে। কেউ যদি চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায় কোন ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা সেখানে বলা হয়েছে, ‘সাধারণ রোগীর চিকিৎসা সেবায় অস্বীকৃতি প্রদানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ’ – এই পত্রটা একেবারেই বিভ্রান্তিমূলক পত্র, নিপীড়নমূলক এবং শিষ্টাচার বহির্ভূত।
দ্বিতীয়বার দেয়া এই চিঠিতে আগের চিঠিটি বাতিল বলে জানানো হয়।
‘এটা কখনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে দেয়ার সুযোগ আছে কিনা আমি জানিনা। এটা হতে পারে এই সরকারকে বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য সরকার এখন যে পজিটিভ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটাকে বিতর্কিত করার জন্য এই ধরণের একটি অর্ডার হতে পারে। কেউ চিকিৎসা দিচ্ছে না এই তথ্য কি সরকারের কাছে আছে কিনা! এখনও কিন্তু চিকিৎসা দিচ্ছে চিকিৎসক, নার্স এবং সেবাদানকারি কর্মীরা। সুতরাং গণ হারে যদি এই চিঠি দেয়া হয় সেটা খুব লজ্জাজনক। আর সেটা পত্রিকাতে বিবৃতি দিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যে হাসপাতালে বা সেবাদান কেন্দ্রে চিকিৎসা হচ্ছে না। একটা চিঠি যখন পত্রিকাতে আসবে তার মাত্রা কিন্তু অন্যদিকে চলে যাবে। সেই করোনা ভাইরাসের মতো। সামাজিক সংক্রমণের মতো। এটা সবাই জানবে যে এখানে চিকিৎসা হয়না। তাহলে কি হবে? মানুষ কি করবে?’
‘বরং এইখানে কি করতে হবে। চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে কোন কোন জিনিসের অপ্রতুলতা আছে এবং যা আছে সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা পরিষ্কার করে দিয়ে যারা চিকিৎসা দিচ্ছে তাদের মধ্যে যদি ভয় ঢুকে যায় সেই ভয়টা দূর করতে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া। সেটা হবে কাজের কাজ। তা না হলে এটা হবে উস্কানিমূলক। ঠিক এমনি করে আর একটি চিঠি দেখলাম, সেখানে বলা হয়েছে – স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই চিঠি ‘করোনা ভাইরাসের উপসর্গ আছে এমন রোগীকে সুরক্ষা পোশাক ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। এ ব্যাপারে প্রথম আলোতে একটা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে, আজ বুধবার এই নির্দেশ জারির পর চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ দেথা দেয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই পত্রটা জারি করার উদ্দেশ্যটা কি! যারা নবীন চিকিৎসক আছে তাদের মধ্যে এটা কি প্রভাব ফেলবে। তো সেইখানে আরো বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের যদি প্রাথমিক লক্ষণ থাকে তাহলে একজন চিকিৎসক পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ছাড়া কি করে চিকিৎসা দেবে?’
চিকিৎসকদের জন্য পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য নোটিশ জারি করা হয়।
গত কয়েকদিন একটা দড়ি দিয়ে নিরাপত্তা বজায় রেখে যখন একজন চিকিৎসক চিকিৎসা করছিলেন তখন সেটা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। এটা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা রোগীর কাছে যাচ্ছেনা। এই জিনিসগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে সামগ্রিক সমন্বয়হীনতার একটা বহি:প্রকাশ। অতিকথন যখন বিভিন্ন তরফ থেকে হয় বিভ্রান্তিকর এইসব জিনিসগুলো আসে এবং দূর্বলতা ঢাকার একটা প্রক্রিয়া এটা বলে আমি মনে করি। এটা কখনোই উচিত না। আজকে গোটা জাতি সংকটের সম্মূখীন। এখানে সবাইকে সমন্বিতভাবে এবং কো অর্ডিনেটওয়েতে একটা সিঙ্গেল ম্যাসেজ দিতে হবে। যাতে করে সেবাদানকর্মীরা নিশ্চিত থাকে। জনগণ নিশ্চিত থাকে এবং আমরা এই ধরণের একটা বৈশ্বিক সমস্যার মোকাবেলা করতে পারি।
‘সরকারকে বিতর্কিত করার জন্যই এই ধরণের পত্র জারি করা হচ্ছে। আবার, পিপিই নিয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য দিচ্ছি না। কারা পরবে? এটা কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক পরবে, এটা কি একজন টিএনও পরবে? এটা কি একজন কর্মচারি পরবে। পিপিই মানে হচ্ছে যে সরাসরি করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবাদান করবে। কোন চিকিৎসকও বলেনি যে আমাদের পিপিই একেবারে বোঝা বেঁধে দিতে হবে। আমাদের যেগুলো দরকার সেগুলো দিতে হবে। এই জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। রাজশাহী মেডিকেলে এখন মাত্র ৩৭০ টা পিপিই আছে। এখন শুধু আমরা শুনছি পিপিই আসছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে এই মুহুর্তে যার দরকার তার জন্য ব্যবস্থা করা হোক।’
আমরা রাজশাহী বিএমএ নবীন চিকিৎসকদের মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছি। আমরা একটা বড় ধরণের এমাউন্ট তুলেছি কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা। পরিচালককে এই টাকা দেব। চিকিৎসক এবং সেবাদানকর্মীদের জন্য যা দরকার উনি কিনে ফেলবেন। এরমধ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে যা খুবই অমানবিক।
আমার মনে হচ্ছে কোন একটি সেকশন এই সমস্ত বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যাতে করে সেবাদান কর্মীদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং তারা উত্তেজিত হয়ে যায়। আমার মনে হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এগুলো দেখা উচিত।’
# অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সভাপতি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলা।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা