গত পাঁচ অর্থবছর থেকে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বকেয়া পরিশোধ করছে না—এমন ৭৯ ব্যক্তি ও ১২৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে রাজস্ব পাওনা প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। গত সপ্তাহে এ তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
ওই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বকেয়ার পরিমাণ, বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিয়ে এনবিআর থেকে কতবার চিঠি পাঠানো হয়েছে, বকেয়া আদায়ে আরো কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—এসব তথ্যও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। এত দিন যারা বিভিন্ন কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে, তাদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে এনবিআর কঠোর অবস্থান নিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অতীতে বড়মাপের অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পাওনার অতি সামান্য দিয়ে সময় নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে দিচ্ছি বা দেব বলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্নভাবে সময় বাড়ানো হলেও এবারে সে সুযোগ দেওয়া হবে না।’
এনবিআরের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ৭৯ ব্যক্তির কাছে এনবিআরের রাজস্ব পাওনা তিন হাজার ৭২২ কোটি টাকা। ১২৪ প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরের পাওনা ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এত দিন এনবিআরের বিভিন্ন কর অঞ্চল এবং কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেট এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত কার্যক্রম নজরদারি করেছে। চলতি অর্থবছর থেকে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট সেল (সিআইসি), ভ্যাট বা মূসক গোয়েন্দা এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকেও ওই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরেও কেন তাদের কাছ থেকে বকেয়ার বড় অংশ আদায় সম্ভব হয়নি তার ব্যাখ্যা চেয়ে গত বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল ও ভ্যাট কমিশনারেটে চিঠি পাঠিয়েছেন। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে এ চিঠির জবাব দিতে হবে।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৭৯ ব্যক্তির প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী। তাঁদের নিজেদের নামে দেশে-বিদেশে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাঁদের পরিবারের একাধিক সদস্যও দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। গত পাঁচ বছরে ৭৯ জনকেই বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জনকে ২০ বার করে, ১০ জনকে ১৬ বার, অন্যদের ১৪ বারের কম চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ৭৯ জনই পাওনা রাজস্বের অতি সামান্য কিছু অর্থ এনবিআরের কোষাগারে জমা দিয়ে আবারও সময় নিয়েছেন। এভাবে বারবার সময় নিয়েও গত পাঁচ বছরে তাঁরা পাওনার ২০ শতাংশও পরিশোধ করেননি। ৭৯ জনের মধ্যে ১৭ জনের হিসাব সাময়িক জব্দ করা হয়। পাওনার অতি সামান্য দিয়ে হিসাবগুলো আবারও সচল করা হয়। এই ব্যক্তিরা নিয়মিত রিটার্ন জমা দিয়েছেন। বেশির ভাগই রিটার্নে ব্যবসায় লোকসান দেখিয়েছেন। সামান্য লাভ দেখিয়েছেন অল্প কয়েকজন।
৭৯ জনের মধ্যে চারজন সিগারেট খাতের ব্যবসায়ী, ৯ জন তৈরি পোশাক ও এর সহযোগী খাতের, তিনজন হোটেল, দুজন সিরামিক খাতের, একজন জুয়েলারি খাতের, একজন অটোমোবাইল খাতের, দুজন খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারক ব্যবসায়ে, সাতজন ঠিকাদার, ছয়জন পরিবহন, আটজন মানবসম্পদ রপ্তানি, ১৩ জন রাসায়নিক আমদানি এবং অন্যরা বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করেন। প্রত্যেকের এসব ব্যবসার বাইরে আরো ব্যবসা আছে। তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বছরে একাধিকবার বিদেশে আসা-যাওয়া করেন। তাঁদের প্রত্যেককে এনবিআরে একাধিকবার তলব করা হয়। এতে ৩৬ জন আইনজীবী সঙ্গে করে হাজির হয়েছিলেন। অন্যরা নিজে না এসে প্রতিনিধি হিসেবে আইনজীবী পাঠান।
১২৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৭টি শতভাগ রপ্তানিমুখী, ১২টি স্থানীয় শিল্প, চারটি মোবাইল খাতের, তিনটি হোটেল, বাকি আটটি আমদানির সঙ্গে জড়িত।
এদিকে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে কঠোর হচ্ছে এনবিআর। প্রতিটি রাজস্ব দপ্তরকে প্রতি মাসের জন্য রাজস্ব আদায় ও করদাতা সংগ্রহে পৃথক লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হবে। এক মাসের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে তা পরের মাসের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে আদায় করে দিতে হবে। কোনো রাজস্ব দপ্তর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে এর যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দিতে হবে। ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না হলে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করদাতাকে ভোগান্তিতে ফেললে তাঁকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। গত মঙ্গলবার এসব নির্দেশ দিয়ে বিভিন্ন রাজস্ব দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। তিনি ইবিআইএন (ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর) গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যবসায়ীদের কাছে তুলে ধরতে বলেছেন। বলা হয়েছে, ইবিআইএন না থাকলে কোনো ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানি করতে পারবেন না। কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবেন না। ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না।
ইএফডি (ইলেট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) যন্ত্র সরবরাহে গুরুত্ব দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে বলেছেন, ইএফডি সরবরাহে এনবিআর চেষ্টা করছে। ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে, এসব যন্ত্র ব্যবহার অত্যন্ত সহজ। একটি মোবাইল ফোন চালানোর মতোই এসব যন্ত্রের সাহায্যে ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখা যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে। আমি আশাবাদী এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। এ জন্য বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে।’
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের শুরুতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। বড় অঙ্কের ঘাটতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা পরে ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
NB:This post is copied from kalerkantho
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা