সাধারণত চিকিৎসাখাতের সুরক্ষার ক্ষেত্রে দুটো দিক থাকে। একটা হচ্ছে, চিকিৎসকদের সুরক্ষা, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভোক্তা বা রোগীর সুরক্ষা। এক্ষেত্রে সাংবাদিকরা রোগীদের যেসব অসুবিধা হতে পারে, রোগীদের যেসব ক্ষতি হতে পারে সেই ব্যাপারে রিপোর্ট তৈরি করে। সেই রিপাের্ট করার ব্যাপারে সরকার যদি বিভিন্ন আইন-কানুন বসানোর ব্যাপারে চেষ্টা করে, তাহলে সাধারণ মানুষ এটা ভাববে যে এটা আসলে যারা ঠিকভাবে নিয়ম মানে না তাদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। তারা ধরেই নিবে যে, যেসব ডাক্তাররা জবাবদিহিতাহীনভাবে বা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কাজ করে তাদের জন্য এই আইন করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষ কোন বিষয় নিয়ে খামোখা ঝগড়া করতে চায়না। যদি রোগীরা ভাল সুবিধা পেত তাহলে মানুষ অসুস্থ অবস্থাতে বিদেশে যাবার চিন্তা করত না। দেশের গরীব রোগীও এখন কলকাতাতে যাবার চিন্তা করে। এই বাস্তবতাটা আমাদের সকলের মেনে নেয়া উচিত। মেনে নিয়ে যদি সমস্যাগুলো সমাধানের কথা চিন্তা করে করি, তাহলে এইরকম একটা আইন হতো না যেটাতে মনে হচ্ছে যে সাংবাদিকরাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু।
সাংবাদিকদেরকে প্রধান শত্রু বানিয়ে কোন লাভ হবে না। পৃথিবীতে কোন ক্ষমতাবান শক্তি আজ পর্যন্ত সাংবাদিকদেরকে প্রধান শত্রু বানিয়ে টিকতে পারেনি এবং এইক্ষেত্রেও হবেনা। বর্তমানের বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিতে চিকিৎসক-রোগীর সুরক্ষায় একটা কাউন্সিল করা দরকার। যেখানে ভোক্তা, চিকিৎসক এবং জনপ্রতিনিধি থাকবে । সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিষয়ক যেসব কমপ্লেইন থাকবে এগুলো যেন পৌঁছায়। এগুলো পৌঁছালে যা হচ্ছে, অত্যন্ত অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো ঘটছে। যেমন মারপিট হয়, ঝগড়াঝাটি হয়, ডাক্তারের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হয়, এমন ঘটনা আমাদের জীবনে বহু হয়। আমাদের দেশের প্রতিটা মানুষের জীবনে এটা হচ্ছে। এজন্য আমার মতে যদি একটু ডাক্তাররা এবং সরকার, এরা যদি এই বিষয়টা বুঝত যে, সাংবাদিকরা অসুবিধা করার জন্যে এই রিপোর্টগুলো করে না। তাদের সামনে এই রিপোর্টগুলো আসে। রিপোর্ট করার বাইরে তারা কিছু করতে পারেনা। তাহলে স্বাস্থ্যখাতে কোন সমস্যাই থাকত না।
এই যে বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে এত চুরি হচ্ছে এগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব কার ছিল? এগুলোর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। এখন বাংলাদেশ যদি একটা রিপোর্ট দেয় যে, সাংবাদিকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন রিপোর্ট করতে পারবে না। সেটা কি খুব ভাল হবে? সরকার কি বুঝতে পারছে না, যে এই ধরণের নিয়মগুলো সরকার চালু করছে এরফলে তাদের উপরে আঘাত আসবে। কারণ, সরকার ভাবছেন, সাংবাদিকরা কি করবে? বা পাবলিক কি করবে? আমি একটা লেখায় লিখে ছিলাম যে, বাংলাদেশের পাবলিক কোনদিনই কিছু করতে পারবেনা। যদি না তারা কোন রোগীলীগ নাম দেয়। তাহলে বাংলাদেশের রোগীরা এখন আওয়ামীলীগের একটা সংগঠন রোগী লীগ তৈরি করুক। তারা এখন রোগী হিসেবে আলাদা একটা সংগঠন করবে, কারণ কেউ তো রোগীদের কথা শুনছে না। সরকার যে, ডাক্তারদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল, রোগীদের পক্ষে দাঁড়াবে টা কে?
এটা কিন্তু খুব যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। এবং এটার উত্তর সরকারি এই সার্কুলারের মধ্যে নেই। সরকারকে জানানো উচিত, কোন কিছু হলে তাদেরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিত। এটা খুবই সাধারণ সাংবাদিকতার নিয়ম। এই সাধারণ সাংবাদিকতার নিয়মের বাইরে এখানে যাওয়া যাবেনা, এখানে বলা যাবে না, এখানে দেখাতে হবে। এখানে কথা বলা যাবে না। এতে মনে হচ্ছে সরকার একটা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করছে তার একটা নির্বাচনী এলাকাতে। অর্থাৎ ডাক্তারদের নির্বাচনী এলাকাতে। খুব ভাল কথা। সরকারি নির্বাচনী এলাকার বড় অস্ত্র হচ্ছে পাবলিক। পাবলিক শেষ সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার যেটা করেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই ঘোষণার কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে দলটা এখন ক্ষমতায় আছে, তাদেরকে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হলো। কারণ, আগামীতেই বিভিন্ন সময় মানুষ যদি সেবা না পায়, মানুষ তো আর সাংবাদিকের জন্য অপেক্ষা করবে না। মানুষ তো নিজে থেকেই ভুমিকা পালন করবে। এটাই তো আমাদের দূর্ভাগ্য।
আজকে অর্থনৈতিক লুটপাটের যে খবরগুলো পড়ি, সরকার কি ভাবছে যে সব পার হয়ে যাচ্ছে? প্রতিদিন মানুষের দুরবস্থা বাড়ছে। রাগ বাড়ছে। মানুষ যদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলে এটা কি সরকারের জন্য খুব ভাল হবে? সে জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই সুরক্ষা না করে জরুরিভিত্তিতে একটা কাউন্সিল করা উচিত। যে কাউন্সিলে যে রোগী যে ভোক্তা মনে করবে যে আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, অসুবিধা করা হয়েছে, গাফিলতি করা হয়েছে, আমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি, রোগী ডাক্তার সেবা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সেখানে এটা করা হোক এবং সেখানে সরকার থাকুক, ডাক্তার থাকুক, সবাই থাকুক। চিকিৎসা পাবার ক্ষেত্রে প্রথম অধিকার কিন্তু রোগীর, ডাক্তারের প্রথম অধিকার না। তাহলে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, ডাক্তারদের স্বার্থরক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। যেহেতু বিএমডিসি আছে। রোগীর স্বার্থ কে রক্ষা করবে? এটা তাহলে চিকিৎসকরা বলুক। মন্ত্রণালয় তো চিকিৎসকদের স্বার্থরক্ষা করতে দাঁড়িয়ে গেছে। রোগীর স্বার্থ কে দেখবে, এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় না বলুক, তাহলে সেই কথাটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হোক।
এমন যদি হয় যে, সব অধিকার ডাক্তারের, সপাতালের, মন্ত্রণালয়ের কর্মচারির, তখন প্রশ্ন উঠবে তাহলে রোগীর স্বার্থ কে দেখবে?
সরকারের সমস্যা যেটা হয়ে গেছে, এখন পাবলিকের কোন ক্ষমতা নেই। তাকে বাদ দিয়েই চলা যায়। সরকার বলতে আমি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছি। নির্ভরশীলতা জনগণের উপরে নয়, প্রফেশনাল গোষ্ঠীর উপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। কিন্তু এটা কি মানুষ খুব পছন্দ করবে? মোটেই তা করবে না। তখন মানুষ প্রতিবাদ করবে, আর সরকার তখন পাবলিককে পেটাবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই ধরণের প্রজ্ঞাপন খুবই দু:খজনক, কারণ সরকার এখনও বলেনি যে,রোগীর অধিকারটা কে দেখবে? রোগী আক্রান্ত হলে কোথায় যাবে? সরকারের গত ৬ মাসের কোর্টের সিদ্ধান্তগুলো দেখা উচিত। মানুষ এখন কোর্টে যাচ্ছে। মানুষের এই ধরণের কর্মকান্ডে এটা তো পরিষ্কার যে, অশান্তিটা বাড়ছে। এটা কারো জন্যই ভাল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই ধরণের প্রজ্ঞাপন দেয়ার আগে ভাবা উচিত, বেশিরভাগ রোগী অসন্তুষ্ট হয় তাহলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে সেটাও ভাবা উচিত।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদন তৈরির ব্যাপারে কিছু নীতিমালা আরোপ করেছে। যা সাংবাদিকমহলসহ বোদ্ধা মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা