অনলাইন ডেস্ক
মোটাতাজা কোরবানির পশু কিনে অনেকে তৃপ্ত হন। হাটে কেউই হালকা-পাতলা গরুর ধারেকাছে ভেড়েন না। এর জন্য বাড়তি দাম দিতেও কার্পণ্য করেন না তারা। বেপারিরাও চেষ্টা করেন হাটে মোটাতাজা গরুর সরবরাহ বাড়ানোর।তবে পশু দেখতে মোটাতাজা মানেই সেগুলো হৃষ্টপুষ্ট নয়। কারণ অনেক অসাধু বিক্রেতা অল্প পরিশ্রমে বেশি মুনাফার লোভে পশুর শরীরে ক্ষতিকর নানা ধরনের হরমোন প্রয়োগ করে থাকেন। এতে ওই পশু অল্প সময়ের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে মোটাতাজা হয়ে ওঠে।
প্রাণী রোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মানবদেহের জন্য এ ধরনের পশুর মাংস ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কেনার সময় দেখেশুনে পশু কেনা জরুরি।
ইতিমধ্যে কোরবানির মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী হাটগুলোতে আগে থেকে পশুর কেনাবেচা হচ্ছে। সরবরাহও বেড়েছে। কোরবানি উপলক্ষে অস্থায়ী হাটগুলো করোনার কারণে বসতে একটু সময় নিলেও আয়োজনের সব রকম প্রস্তুতি রয়েছে। এর আগেই অনলাইনে পশু কেনাবেচা শুরু হয়েছে।
কোরবানিদাতারা সাধ্যের মধ্যে খুঁজছেন পছন্দের পশুটি। পশু কোরবানির তালিকায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও খাসি রয়েছে। এর বাইরে সামর্থ্যবানদের অনেকে উট এবং দুম্বা দিয়েও কোরবানি করেন। তবে দেশীয় সংস্কৃতিতে বেশিরভাগ কোরবানিদাতা সাধারণত গরুকেই কোরবানির পশু হিসেবে বেছে নেন। সে অনুযায়ী হাটগুলোতেও গরুর সরবরাহও বেশি হয়। তবে হাটে হাজার হাজার গরুর মধ্য থেকে কিংবা খামার থেকে অনেক গরুর ভিড়ে কোন গরুটি কেনা উচিত বা কেমন গরু কিনবেন কোরবানিদাতা, সে বিষয়ে অনেকের সম্যক ধারণা নেই।
ক্রেতা বা কোরবানিদাতার সুবিধার্থে নিউজবাংলা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ভাল বা খারাপ গরু চেনার প্রাথমিক কিছু লক্ষণ বা পরীক্ষা করার পদ্ধতি তুলে এনেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক খাদ্যে বেড়ে ওঠা গরুর বাহ্যিক ধরন দেখেই চেনা যায়। এ ধরনের গরুর সব সময় তেজি ভাব থাকে। এর শারীরিক আকার ও গঠন যত মোটা এবং ওজন যতই হোক না কেন, সেটি কখনোই হেলে বা ঢলে পড়বে না। বাঁধা অবস্থায় প্রায়ই যেনতেনভাবে ছুটতে চাইবে। ঘন ঘন লেজ নাড়বে। হাঁকডাকে জোরালো হবে। এ দুরন্তপনার মধ্যেও পরক্ষণেই আবার সামনে রাখা খাদ্যে মুখ ডোবাবে। সামলাতে একাধিক লোকের দরকার হবে।
পশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটাতাজা নয়, কোরবানিকৃত পশু হতে হবে হৃষ্টপুষ্ট। শরিয়ত অনুযায়ী এ পশুর বয়স হতে হবে গরু বা মহিষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর এবং ছাগল বা ভেড়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক বছর। আবার মোটাতাজা হলেও ক্ষতি নেই। তবে সে পশু হতে হবে বলবান এবং দুরন্ত, যা ঘাস, খড়, রাব, খৈল, ভুষি, কুড়া এবং ভাতের মাড়ের মতো প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক খাদ্যে বেড়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্যকর উপায়ে মোটাতাজা করা গরু চেনার উপায় হচ্ছে কোরবানিদাতার দূরদর্শিতা ও পর্যবেক্ষণের ধৈর্য। কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করলেই সেটি তাদের চোখে ধরা পড়বে।
এ ধরনের পশু চেনার আরও সহজ উপায় হচ্ছে পশুর শরীর টিপে টিপে দেখা। এর তুলতুলে শরীরের যে কোনো স্থানে জোরে টিপ দেয়া সত্ত্বেও হাত বা আঙুল উঠিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপরিভাগের চামড়া এবং ভেতরের মাংসপেশি সতেজ ও টান টান হয়ে ওঠবে।
অপরদিকে ক্ষতিকর রাসায়নিক বা স্টেরয়েড হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে মোটাতাজাকৃত গরুর শরীর টিপে দিলে চামড়া ও ভেতরের মাংসপেশি সতেজ ও টান টান হতে কিছু সময় লাগবে। এছাড়া এ ধরনের গরুর শরীর বেশ থলথলে দেখাবে। সহজে নড়াচড়া করবে না। স্থির ও ঝিমানো ভাব থাকবে। খাবারে মুখ ডোবাবে কম।
স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা পশু বিশেষ করে গরু, ছাগল দেখতে সুঠাম হবে। এদেরকে যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রাণবন্ত দেখাবে। লোম খুব মসৃণ হবে। কঠিনভাবে বেঁধে রাখা হলেও চাইবে ছোটাছুটি করতে। আর বয়স অনুযায়ী শরীরের চামড়ার পুরুত্ব স্বাভাবিক থাকবে। চোখ থাকবে স্বচ্ছ।’
অন্যদিকে অস্বাভাবিক উপায়ে দ্রুত মোটাতাজা করা পশু দেখতে দুর্বল মনে হবে। শরীর হবে থলথলে। সাধারণত এসব পশুর চামড়ার নিচে পানি জমে থাকে। পশুর শরীরে চাপ দিলে গর্তের মতো দেখাবে। এদের শরীরের মেদের তুলনায় চামড়া পাতলা হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য বিভাগের ভ্যাটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. শারমিন সামাদ জানান, কোরবানির পশু হতে হবে হৃষ্টপুষ্ট। সেটি মোটাতাজাও হতে পারে, পাতলা ফিনফিনেও হতে পারে।
সুস্থ ও স্বাভাবিক পশু চেনার উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গরুর মুখের সামনে ঘাষ, খড় কিংবা খাওয়ার যাই আছে, তা তুলে ধরুন। গরু সুস্থ হলে তা কিছু না কিছু মুখে তুলে নেবেই। এটা হচ্ছে চেনার প্রাথমিক উপায়।’
এ ছাড়া পশুকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে তিনি পশুর নাকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘সুস্থ পশুর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে থাকবে। দেখবেন মুখে জাবরও কাটছে।’
অস্বাভাবিক পশু চেনার উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হাটে বা বিক্রয়কেন্দ্রে এ ধরনের গবাদিপশুর শরীরে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হবে। দেখা যাবে পাতলা পায়খানা হচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। সামনে খাবার থাকলেও খাচ্ছে না, এমনকি জাবরও কাটছে না। ক্ষতিকর রাসায়নিক, স্টেরয়েড হরমোন কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া কোরবানির পশুর শরীরে এ প্রবণতা দেখা যাবে।’
জানা গেছে, মৎস্য ও পশু খাদ্য আইন ২০১০ অনুযায়ী পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ বা ব্যবহার নিষিদ্ধ।
পশুর শরীরে এ ধরনের হরমোন প্রয়োগ করে মোটাতাজা করা হলে এবং ওই পশুর মাংস খেলে কী ক্ষতি হতে পারে, প্রশ্ন রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লৎফুল কবিরের কাছে।
এর জবাবে তিনি নিউজবাংলাকে জানান, হরমোন ও স্টেরয়েড গবাদিপশুর শরীরে প্রয়োগ করা হলে তা প্রস্রাবের সঙ্গে বের হতে পারে না। আবার পশু ঘামে না বলে মাংসপেশির ফাঁকে পানি জমা হয়, যা পশুর মাংসকে ফুঁলিয়ে দেয় এবং দ্রুত ওজন বাড়িয়ে অস্বাভাবিক মোটা করে তোলে, এতে পশুর শরীর হয়ে যায় থলথলে।
ড. এ কে লৎফুল কবির বলেন, স্টেরয়েডসমৃদ্ধ গবাদিপশুর মাংস মানবদেহে কিডনি ও লিভারের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। তা মানবদেহে ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে মেয়েদের স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সারের সম্ভাবনা তৈরি করে। আর যে কোনো সময় উচ্চরক্তচাপ এবং উচ্চ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
তিনি আরও জানান, স্টেরয়েডসমৃদ্ধ মাংস বেশি খেলে ফার্মের গরু ও মুরগির মতো মানুষও অস্বাভাবিক স্থূলতায় ভুগতে পারে। এই মাংস পুরুষের শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত করে। আর নারীর শরীরে হরমোন নিঃসরণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। এর ফলে সন্তান ধারণসহ জৈবিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটতে পারে, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে।
তিনি কোরবানিদাতাদের প্রতি পরামর্শ রেখে বলেন, পশু মোটাতাজা কিংবা পাতলা ফিনফিনে যেটাই হোক, তা হওয়া উচিত সুস্থ ও স্বাভাবিক।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা