সারাবিশ্বের এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত। হলিস্টিক এপ্রোচ টু সেরিব্রাল পালসি (Holistic Approach to Cerebral Palsy) শীর্ষক বিষয়ে বক্তৃতায় বক্তারা একথা বলেন।
বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস-২০১৯ উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা)’র এফ ব্লকের ৭ম তলায় বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ৮টায় সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ‘ফ্রি সেরিব্রাল পালসি সেবা ক্যাম্প’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ১২টায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ ও রেসিডেন্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত বৈজ্ঞানিক সেমিনারের প্রধান অতিথি হিসেবে শুভ উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।
বৈজ্ঞানিক সেমিনারের আলোচনায় বক্তারা “হলিস্টিক এপ্রোচ টু সেরিব্রাল পালসি (Holistic Approach to Cerebral Palsy) শীর্ষক বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও সেরিব্রাল পালসি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এবং বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনায় অংশ নেন বিভিন্ন শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞগণ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক গুণাবলী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার সুযোগ্য কন্যা, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট জনাব সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের অবদানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে “ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতিদরিদ্র রোগীদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত তিনবারে মোট ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন।
বর্তমানে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক দরিদ্র রোগী প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি ও ডাউন সিনড্রম নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যমান কুসংস্কার দূরীকরণে জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. সাহানা আখতার রহমান বলেন, নিউরো ডিজঅর্ডারসহ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের উন্নত চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। তবে এই রোগ ও সমস্যা আগেভাগে চিহ্নিত হলে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দেয়া গেলে তাঁদেরকে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রেনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক গুণাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বে বিরল। অটিজম শিশুদের নিয়ে রাষ্ট্রোনায়ক শেখ হাসিনার ভাবনাকে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে সফল করে তুলতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার এন্ড অটিজম (ইপনা)-এর সম্মানিত পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহীন আকতার বলেন, অটিজম ছাড়াও প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার জন্য বর্তমান সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ইপনার বহির্বিভাগে আসা রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ রোগীই সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো লেটস মুভ এ্যাস ওয়ান অর্থাৎ সকলে মিলে এক সাথে সেরিব্রাল পালসিকে মোকাবিলা করতে হবে। চিকিৎসক, থেরাপিস্টসহ সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে সেরিব্রাল পালসিকে প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করতে হবে। সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ, ইপনার ডেপুটি ডিরেক্টর (শিক্ষা) সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন উপ-পরিচালক (প্রশাসন) সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু।
সেমিনারে জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী সেরিব্রাল পালসি বা সিপিতে আক্রান্ত শিশু ও ব্যক্তিবর্গের অধিকার, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বা সহজ প্রবেশাধিকার এবং সমান সুযোগ সুবিধা আদায় আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রতি বছর সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হয় বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি (সিপি) দিবস। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, তাঁদের পরিবার এবং এ সংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের যৌথ প্রয়াসে এই দিবস পালিত হয়। সারা বিশ্বে প্রায় এক কোটি ৭০ লক্ষের অধিক ব্যক্তি ও শিশু সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত। আর এদের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত আছে আরো প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ।
শিশু বয়সে সবচেয়ে বেশি শারীরিক প্রতিবন্ধিতা দেখা দেয় এই সিপি’র কারনে। সিপি আক্রান্ত শিশুদের প্রতি চার জনের একজন কথা বলতে পারে না, প্রতি তিন জনের একজন চলাফেরা করতে পারে না, প্রতি দুই জনের একজনের মধ্যে বুদ্ধিহীনতা দেখা দেয়। অধিকন্তু প্রতি চার জনের একজন সিপি’র পাশাপাশি এপিলেপসি বা মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়। এটি জীবনব্যাপী সমস্যা।
সেরিব্রাল পালসি মস্তিস্কের একটি স্থায়ী বা নন-প্রগ্রেসিভ ধরণের স্নুয়ুবিক ভারসাম্যহীনতা যা গর্ভাবস্থায় অথবা জন্ম পরবর্তিকালে শিশুদের মস্তিস্ক গঠনের সময়ে কোন প্রকার আঘাতজনিত কারণে হয়ে থাকে।
ভারসাম্যহীনতার কারণে নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টিপাত করতে না পারা, দাঁতের সমস্যা ইত্যাদি। এছাড়া এর সাথে সাথে বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা দেখা দিতে পারে। সিপি আক্রান্ত শিশুদের একই সাথে মৃগিরোগ অন্ধত্ব কিংবা বধিরতার মত সমস্যাগুলোও থাকতে পারে।
সেনিারে সেরিব্রাল পালসির কারণসমূহ সম্পর্কে বলা হয়, জন্মকালীন সময়ে মস্তিস্কে অক্সিজেনের সরবরাহ কম হলে বা কমে গেলে শিশু’র মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, গর্ভকালীন মায়ের জীবানু ঘটিত কোন সংক্রমণ হলে তা গর্ভের সন্তানকে আক্রান্ত করতে পারে এবং মস্তিস্কের গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে, জন্ম পূর্ব অথবা পরবর্তি সময়ে শিশুর মস্তিস্কে সংক্রমণ হলে, গর্ভকালীন সময়ে শিশু মস্তিস্কে আঘাত প্রাপ্ত হলে, কোনো কারণে কিংবা কোন দুর্ঘটনায় শিশু অপরিণত বয়সে মাথায় আঘাত পেলে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, অপরিণত বয়সে শিশু জন্মগ্রহণ করলে, নবজাতকের বেশিমাত্রায় জন্ডিস হলে, কোষের অভ্যন্তরে অবস্থিত মানব বৈশিষ্ট্যের ধারক জিনের পরিবর্তন (মিউটেশন) সংগঠিত হলে মস্তিস্কের অস্বাভাবিক গঠন দেখা দিতে পারে।
সেমিনারে আরো বলা হয়, এই রোগ নির্ণয়ে প্রাথমিকভাবে কোনো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ শিশুর লক্ষণসমূহ ও তার জন্ম ইতিহাস বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে সিপি আত্রান্ত কিনা তা’ সনাক্ত করতে পারেন।
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি প্রতিরোধ করা যায় না, তবে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কিছু কিছু পদক্ষেপ নিলে গর্ভবতী মা অথবা গর্ভধারণে ইচ্ছুক মহিলা এ ধরণের জটিলতাকে কমিয়ে আনতে পারেন। যেমনঃ গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত এবং সময়মত টীকা গ্রহণ, এর ফলে ভাইরাসজনিত আক্রমণ থেকে ভ্রুণের মস্তিস্ক গঠনকে রক্ষা করা সম্ভব। গর্ভকালীন সময়ে কোনো প্রকার ইনফেকশন বা সংক্রমণ যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
গর্ভবতী মায়েদের যথাসময়ে এবং নিয়মিত শিশুর জন্মপূর্ব যত্ন নেয়া। নিয়মিত ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে শিশুর অকাল জন্ম, কম জন্ম ওজন, এবং সংক্রমণ থেকে শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। গর্ভবতী মা’কে নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র অথবা হাসপাতালে নিয়ে প্রসব করানোর ব্যবস্থা করা সম্মিলিত চেষ্টা এবং সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমে সিপি আক্রান্ত রোগীরা উন্নত জীবন যাপন করতে পারে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা