শান্তা মারিয়া : প্রথমেই একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। মনগড়া নয়, ডেস্কমেড নয়। বাস্তব। নাম প্রকাশ করছি না সংশ্লিষ্ট নারীর সম্মানের জন্য। একটি দৈনিকে দীর্ঘদিন সিনিয়র সাব এডিটর পদে কাজ করেছিলেন রেবা সুলতানা(প্রকৃত নাম নয়)। পত্রিকাটির বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়লে তিনি বেশ অসুবিধায় পড়েন। তখন নতুন একটি দৈনিক বাজারে আসার কথা। বেশ উচ্চবেতনে নিয়োগ হচ্ছিল সেখানে। যারা নিয়োগ পাচ্ছিলেন তাদের চেয়ে যোগ্যতা কিছুটা বেশিই ছিল রেবার।
তিনি সরাসরি যোগাযোগ করলেন নিয়োগদাতাদের সঙ্গে। নিয়োগদাতাদের মধ্যে ছিলেন পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক যিনি নিজেও একজন সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি রেবাকে বললেন, ‘আপনার তো বয়স হয়ে গেছে। আমরা ফ্রেশার চাচ্ছি।’ রেবা বললেন, ‘কিন্তু আপনাদের পত্রিকায় তো অনেক অভিজ্ঞ সাংবাদিকও নিয়োগ পাচ্ছেন যারা আমার চেয়েও বয়স্ক।’ সেই সম্পাদক উত্তর দিলেন, ‘আমরা বয়স্ক নারী চাচ্ছি না।’ এর পরে কি আর কোন তর্ক চলে? না তর্ক করার ইচ্ছা অবশিষ্ট থাকে? নারীসাংবাদিক কথাটা বললেই বিদ্রুপাত্মক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে অনেক পুরুষ সাংবাদিকের চেহারায়। কেউ কেউ তো বলেই বসেন, ‘সাংবাদিকের আবার নারী-পুরুষ ভেদ করছেন কেন? আপনারা নিজেরাই তো নিজেদের অবমাননা করেন’। একথার জবাবে বলতে ইচ্ছা করে, শুধু সাংবাদিকতা কেন, কোনো পেশাতেই নারী-পুরুষ ভেদ করার প্রয়োজন হতো না, যদি না নারীর জন্য পরিস্থিতি সবসময় বৈষম্যমুক্ত হতো। কিন্তু তাতো হয় না। বাস্তব চিত্র যে বড়ই করুণ।
নারী সাংবাদিকদের একটি প্রধান সমস্যা হলো ‘বয়স হয়ে যাওয়া’। বয়স বাড়লে পুরুষ সাংবাদিকরা অভিজ্ঞ হন, তারা উচ্চতর পদে ঢুকতে পারেন, তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আর বয়স বাড়লে নারী সাংবাদিকরা চলে যান ‘বাতিলের খাতায়’। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অনেক খ্যাতিমান ও যোগ্য নারীসাংবাদিক এই পেশা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন চল্লিশ ও পঞ্চাশ বছর বয়সের পরে। তারা কোথাও চাকরি পাননি। বছরের পর বছর তাদের পদোন্নতি হয়নি। নতুন কোনো পত্রিকায় যখন তারা যোগ দিতে গিয়েছেন, তাদের শুনতে হয়েছে ‘আমরা ফ্রেশার চাচ্ছি’। টিভি চ্যানেলগুলো পত্রিকা থেকে যাওয়া চল্লিশোর্ধ নারী সাংবাদিকদের পাত্তাই দেয়নি। দৈনিক পত্রিকা থেকে অনেক পুরুষ সাংবাদিক টিভিতে যেতে পেরেছেন কিন্তু পত্রিকা থেকে নারীরা তেমন সুযোগ পাননি দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া।
পত্রিকায় নারী সাংবাদিকের সংখ্যা পিরামিডের মতো উপরের দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কোনো পত্রিকায় সাব এডিটর পদে হয়তো বেশ ক’জন নারী কাজ করছেন। কিন্তু যখন সিনিয়র সাব এডিটর পদে প্রোমোশনের বিষযটি আসে তখন প্রধানত পুরুষরাই সে পদে চলে যান। পত্রিকার বিজনেস এডিটর, ফিচার এডিটর, নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার, এক্সিকিউটিভ এডিটর এসব নীতি নির্ধারণী পদগুলোতে নারীর সংখ্যা বিরল। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে নিউজরুম এডিটর পদে নারী আছেন অনেকেই। কিন্তু চিফ নিউজ এডিটর, হেড অফ নিউজ পদে নারীর সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা।স্বামী বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়ের সূত্রে নয়, সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার থেকে কোনো দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক পদে এখনও কোনো নারীকে আমাদের দেশে দেখা যায়নি।
প্রদীপের নীচেই অন্ধকার থাকে। নারী সাংবাদিকরা সমাজের কতশত সমস্যার কথা তুলে ধরেন কিন্তু তাদের নিজেদের সমস্যা ও বেদনা গুমরে মরে মিডিয়া হাউজগুলোর ভিতরেই।প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নারী সাংবাদিকদের একটি অকথিত মর্মান্তিক বেদনার বিষয় হলো যৌন হয়রানি।
বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চেহারায়, বিভিন্ন আকারে, ছোট বড় বিভিন্ন গুরুত্বে এই সমস্যাটি হাজির হয় মিডিয়ায় কর্মরত নারীদের সামনে।কখনো প্রেমের প্রস্তাব, কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, কখনো যৌনগন্ধী বিদ্রুপ ও কথাবার্তা, কখনো যৌন হুমকি, কখনো কম্পিউটার স্ক্রিনে অশালীন ছবি সেভ করে রাখা, কখনো ফেইসবুকে হয়রানি, আবার কখনো আড়ালে আবডালে তার নামে রসালো আলাপ, কখনো তার চরিত্রে বদনাম আরোপ-এমন কোনো নারী সাংবাদিক নেই যিনি পেশাজীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এগুলোর মুখোমুখি হননি। প্রতিবাদ করতে গেলে হয় তার চাকরি যায় অথবা তাকে উদ্দেশ্য করেই নানা রকম বিরূপ কথাবার্তা চালু হযে যায় অফিসে। অনেক সময় খেতাব জোটে ‘পাগল মহিলা’।
কর্মক্ষেত্রে যদি কোনো বিবাহিত নারী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত সহকর্মীর সঙ্গে তাহলে শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয় নারীটিকেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকরি হারাতে হয় নারীকে এবং নানারকম অবমাননার শিকার হতে হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সিনিয়র পুরুষ সহকর্মী অথবা কর্তৃপক্ষের যৌন হয়রানির শিকার হয়ে নিরবে চাকরি ছেড়েছেন অনেক নারী সংবাদকর্মী কারণ প্রতিবাদ করে বিষয়টি নিয়ে হইচই করলে তারই সামাজিক সুনাম ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কিল খেয়ে কিল হজম করেই অনেকটা চুপিসারে বিদায় নেন তারা। অথবা হয়রানিকারীর কুপ্রস্তাবে অনিচ্ছা সত্তেও সাড়া দিয়ে নিজের চাকরি ও পজিশন ধরে রাখেন অনেক নারী।
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন বৈষম্য রোধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স স্থাপনের বিধান হাইকোর্ট দিলেও এখনও কোনো মিডিয়া হাউজে এ ধরনের অভিযোগ বাক্স চোখে পড়েনি। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র নারীকর্মীসহ সিনিয়র কর্মীদের নিয়ে একটি কমিটি থাকার বিধানও রয়েছে। কিন্তু কাজীর গরু এখনও কেতাবেই রয়ে গেছে অভিযোগ বাক্স ও হয়রানি প্রতিরোধক কমিটির অস্তিত্ব কোনো মিডিয়া হাউজেই নেই।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলছে # মি টু আন্দোলন। এই আন্দোলনের ঢেউ লাগে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের একজন নারী সাংবাদিক অভিযোগও করেন পত্রিকার একজন সিনিয়র পুরুষ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশে মি টু আন্দোলন তেমন সাফল্য পায়নি। কারণ অনেক সময় কোন নারী সাংবাদিক যদি সাহস করে অভিযোগ করেনও তখন কোন বিচার হয় না। আবার ওই মিডিয়ার অন্য নারী সাংবাদিকরা অসচেতনতার কারণে কিংবা পদ ও সুবিধা হাসিলের উদ্দেশ্যে অভিযুক্তের হাতকে শক্তিশালী করেন। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত হন ক্ষমতাশালী। ক্ষমতার বলয়ে থেকে নিজেরাও ক্ষমতার ভাগ চান, সুবিধা চান অনেক নারী। অথচ এই প্রবণতা পুরোপুরি আত্মঘাতী। কারণ নারীরা যদি সকল প্রকার বৈষম্য ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতেন তাহলে সুস্থ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইটা অনেক সহজ হতো সকলের জন্যই।
ঢাকার বাইরে মফস্বলে যে নারীরা সাংবাদিকতা করেন তাদের অবস্থা অনেক বেশি প্রতিকূল।মফস্বলে কোনো নারী যখন কোনো জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হতে চান তখনি স্থানীয়ভাবে অন্য পুরুষ সাংবাদিকদের দ্বারা তার বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রচার প্রচারণা। তাকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। তাকে স্থানীয় প্রেসক্লাবে রীতিমতো একঘরে করে ফেলা হয়। বলা হয়, সাংবাদিকতার কাজটি পুরুষের। এখানে নারীর ‘নাক গলানো’র প্রয়োজন নেই। এমনকি অনেক সময় নানা রকম হুমকি ও ভয়ভীতিও প্রদর্শন করা হয়।এই অভিযোগগুলো কোনোটাই আমার মনগড়া নয়। নারী সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারে এ ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন নারীরা।
বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। এটি ‘পুরুষ-প্রধান’ বা মেলডমিনেটেড পেশাও বটে। বাংলাদেশেও সাংবাদিকতাকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বলেই মনে করা হয়।সাংবাদিকতা পেশার বিপদ, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক সংকট এগুলো নারী পুরুষ দুজনের জন্যই রয়েছে। সেইসঙ্গে নারীর জন্য যে রয়েছে কিছু বাড়তি ভোগান্তি সে কথা অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে?
সাংবাদিকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী সংগঠনগুলো যদি কেবলমাত্র মালিক ও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত থাকে তাহলে এ ধরনের সমস্যার সমাধান কখনই সম্ভব হবে না।
সাংবাদিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এই সংগঠনগুলো যেন নারীদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মালিকপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে সেগুলোও নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকতা পেশায় নারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী কিছুটা হলেও ক্ষমতায়িত হবে। সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
# শান্তা মারিয়া, লেখক : কবি, সাংবাদিক।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা