তাসকিনা ইয়াসমিন
ঐখানে এসে ঐ গাড়িটা থামল। আমি তখন ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছি। এদিকে সংগ্রাম কমিটির যে রাইফেলগুলো ছিল সেগুলো আমি নিয়ে এসে আমার বাড়িতে একটা ইন্দারা ছিল সেটায় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে দিলাম। আর একটা রাইফেল আমার বাসায় যে ঘর ছিল, ঘরের পাশে ছিটকির জঙ্গল ছিল সেই ছিটকির জঙ্গলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার বাবার যেন আমার উপর কোন আক্রোশ না হয়। কারণ, বাবা আমাকে নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি আমি কি করে বসি! তো যদিও তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তিনি যুদ্ধের বিষয়ে খুব অভিজ্ঞ ছিলেন। তারপরে তিনি আমাকে বললেন, তোর আর এখানে থাকার দরকার নেই। তুই গ্রামের বাড়িতে চলে যা। তখন গ্রামের বাড়িতে যাবার আর অন্য কোন উপায় নেই। হয় যেতে হবে পায়ে হেঁটে অথবা নৌকায়। কারণ এখানে থাকার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ঐ রাতে আমি আব্বাকে না জানিয়ে আমার রাইফেলটা নিয়ে রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে আমি লাহিড়ী মোহনপুর হয়ে আমার যে বাড়ি শাহজাদপুর থানায় সেখানে আমার একটা নানার বাড়ি ছিল প্রথমে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তো এই রাইফেলের সাথে সাধারণ মানুষের কোন পরিচয় ছিলনা। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত্র হবে, কিভাবে সবাই আমাকে গ্রহণ করে। এইটা নিয়ে আমি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম।সেই কারণে প্রথমেই তখনকার দিনে এখনকার মতো এত এত পলিথিন ছিলনা। তখন বাঁশঝাড়ের নিচে ছালা যেগুলোর মধ্যে ধান চাল ভরে রাখত, সেগুলো দিয়ে জড়িয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে রাখলাম। রেখে চলে গেলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখান থেকে পাঁচ সাত মাইল দূরে। একদম গহীন পল্লীর মধ্যে।
এরমধ্যে আমার ফাদার খবর দিল যে আমরা সপরিবারে চলে আসছি। তো সপরিবারে চলে আসছি বলার পরে আমাকে বলল যে তুমি একটা গরুর গাড়ি নিয়ে করোতোয়া নদীর ধারে দেখ আমরা সবাই আছি। তখন আমি সারাদিন অপেক্ষা করলাম সন্ধ্যার দিকে আমার মা, বাবা, ছোট ছোট ভাইবোন সবাইকে নিয়ে তিনি হাজির হলেন। সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসলাম। তখন এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে। আসার পরে তখন সবেমাত্র আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকার জায়গা আছে কিন্তু ধান, চাউল, ফসল তো তেমন নাই। আব্বার বেতনের উপরেই আমরা সাত ভাইবোন ছিলাম। নির্ভরশীল ছিলাম। কিছুদিন পরেই আব্বার বেতনের যে টাকাটা সেগুলো ফুরিয়ে এলো। তো আব্বা বললেন যে এই যুদ্ধ কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয় তো একটা কিছু তো করে খেতে হবে আমাদেরকে। আমাদের তো অনেক জমি আছে সেগুলো কামলা দিয়ে ধান হয়েছে ছোট ছোট, পাট হয়েছে ছোট ছোট এগুলো নিড়ানি দিতে হচ্ছে। নিড়ানি দেয়ার টাকা নাই। চলো আমরা নিড়াই। আব্বা আবার এগুলো আগে থেকেই জানতেন যেহেতু কৃষকের সন্তান ছিলেন। আর আমরা তো কৃষকের সন্তান ছিলাম না, আমরা চাকরিজীবীর সন্তান ছিলাম।
তো বলল চলো আমরা মাঠে গিয়ে নিড়ানিটা শিখি। তোমাকে শিখাই অন্তত কিছু জমি নিড়াতে পারলে অন্তত কামলার দামটা দিতে হবে না। কিন্তু তখন আমার মনের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা, না যুদ্ধে যাব, যুদ্ধে যাব। কিন্তু বাবা মা ভাইবোনকে ফেলে যুদ্ধে যাওয়া কেমন হয়? আর একটা অবস্থানে আমার বাড়ি ছিল, সারা বাংলাদেশের বর্ডার মিডল পয়েন্টে। রাস্তাঘাট চিনিনা, টাকা-পয়সা নাই। কিভাবে যাব সেটা চিন্তা করতেছি। এরমধ্যে একদিন আমাকে ধানের জমিতে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে কামলাদের সাথে। তখন আউশ আমনের মিশ্র ধান হতো। তো, আউশ ধান কোনটা, আমন ধান কোনটা এটা তো আমি সনাক্ত করতে পারতাম না। পরে, আমাকে দেখিয়ে দিত যে এটা ধান এটা ঘাস, আমি নিড়াতে গিয়ে ধানও কাটি, ঘাসও কাটি- দুটোই তুলছি। তখন আমার পাশের যে আমলা সে আমার আব্বাকে বলছে যে, মাস্টার সাহেব আপনার ছেলে তো আপনার জমি পাঘাল করে ফেলছে। পাঘাল মানে কি, জমি নষ্ট করে ফেলবে। তাকে আইলের পাশে বসিয়ে রাখেন। তখন আমার আব্বা বলল যে, ওকে তো শিখতে হবে। কতদিন যুদ্ধ চলে। কে জানে। তো, আমি সব শুনলাম। আব্বা বলল, শিখুক আগে। আমি মনে মনে চিন্তা করি কিভাবে যুদ্ধে যাওয়া যায়। আব্বা বলল যে, যেহেতু ধান চিনতে পারেনা, তাকে পাটের ক্ষেতে দিয়ে দিই। পাট গাছ তো চেনায় যায়। পাটের জমিতে সবই তো ঘাস। ঠিক আছে গেছি। পাটের জমিতে তার পরেরদিনই নিয়ে গেল। নিয়ে যাওয়ার পরে পাটের জমিতে তখন নিড়ানি দিচ্ছে। তো পাটগুলো এত বড় হয়েছে। এইরকম পিছন দিকে উঁচু করে যে যেতে হবে এটা তো আমি জানিনা।
তারা যায় কিন্তু আমি পারিনা। না জানার কারণে পাটের সাথে ঘষা লেগে পাটগুলো শুয়ে পড়ছে। তখন কামলারা বলল যে, পাট মরে যাবে। তাকে দিয়ে হবে না। এভাবে দুইতিনদিন চলল। তখন আমি সাথী খুঁজছিলাম যে কাকে নিয়ে যাওয়া যায়। তখন আমার গ্রামের মধ্যে আমার দুই পরিচিত ছোট ছিল। তারা পরস্পর আত্মীয় আমার। তাদেরকে বোঝালাম যে, আমরা যুদ্ধে যাব। পালিয়ে চলে যাব আমরা। ওরা রাজি হলো। তখন টাকা পয়সা নাই। ওরা আবার ধনী পরিবারের আদরের সন্তান ছিল। একজন বলল যে, আমার দাদির যে পুরানা সুটকেস ছিল সেখানে বহু পুরোনো টাকা পয়সা আছে। ডিম বিক্রি করে করে, বা অন্যান্য জিনিস করে রাখে। আরেকজনের জ্যাঠাইমা, বড় চাচার কোন ছেলেমেয়ে ছিল না তার টাকা আছে। আমার টাকা পয়সা খুব কম। আমাকে বাজার করতে দিত। আমি বাজারের টাকা থেকে এক আনা দুই আনা করে জমাতাম। আমার কাছে সাড়ে সাত টাকা ছিল।
এরমধ্যে আমার জ্বর হয়েছে। জ্বর থেকে উঠলাম সাতদিন পরে। মা আমাকে ভাত খেতে দিয়েছে। আমি তখন পালানোর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। যেদিন আমি ভাত খাচ্ছি মা বলছে যে ভাত বেশি খাস না প্রথম। ভাত বেশি খেলে জ্বর আসবে আবার। কম করে দিচ্ছে ভাত। তো, আমি মনে মনে বলছি খুব কষ্টের কাহিনি, মা আমাকে তো পেট ভরে খেতে দিলেন না। আজকেই আমি চলে যাব। মনে মনে বলতেছি। সত্যি সেদিনই খেয়ে উঠেই পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই আমরা পালিয়ে চলে গেলাম।
পালিয়ে অনির্দিষ্ট পথযাত্রা। ওখান থেকে আরও একটি বাজারে গেলাম। সেখান থেকে দুজন ছিল তারাও আসবে। তারা আসল। তখন আমরা একটা নৌকায় করে নদীপথে চলে গেলাম সলক নামে একটা জায়গায়। সেখান থেকে গিয়ে নৌকা ছেড়ে দিয়ে সবাই বলল যে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর আছে, কাজীপুর দিয়ে ওখান থেকে মাইনকার চর শরনার্থী নৌকা যায়। সেখান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যায়। কাজীপুর কোথায় কোন দিকে কতদূর যেতে হবে সেটা সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিলনা। আমরা বললাম ট্রেনে সিরাজগঞ্জে যাই। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সিরাজগঞ্জে চলে যাব। লোকে বলছে যে, ট্রেনে মিলিটারি আসে। ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাহলে ডিসগাইসড হয়ে যাই। আমি জ্বর থেকে উঠেছি। আমার মাথা ন্যাড়া করা। হ্যাংলা পাতলা মানুষ ছিলাম। তখন আমার এক মামাত ভাই ছিল আমার চেয়ে একটু বড়। সে বলল যে, আমি তোর অভিভাবক। আর আমাদের সাথে যে দুইজন আছে। তাদের একজনকে পাঁচন দিয়্যা আর কাচিঁ দিয়্যা আর মাথায় পাঁচন দিয়্যাঁ, মাথায় মাশাল দিয়্যা ডিজগাই সাজ্যা স্টেশনে দাঁড়াইছি। এখন দেখি ট্রেন আসতেছে। আর পিছনে বগির পার্শ্বে অস্ত্র ধরে পাক বাহিনীর লোকজন আছে। সব লোক ভয়ে পালাচ্ছে দৌড়ে। তখন আমরাও দেখলাম যে আমাদেরকে পেলে তো ধরে নিয়ে যাবে। তো আমরাও পালালাম। পালাইয়া চিন্তা করলাম কিভাবে যাওয়া যায়? তখন এক লোক বলল যে আপনারা এদিক দিয়ে ভদ্রঘাট নামে এক জায়গা আছে ভদ্র ঘাট দিয়ে আপনারা নদী পার হয়ে ঐখানে এক হিন্দু বাড়ি আছে, ঐ বাড়িতে উনারা শরনার্থী নৌকা দিয়ে দিয়ে ইন্ডিয়ায় লোক পাঠায়। আপনারা সেইদিকে হাঁটা দেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরও পাঠায়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রঘাটে গেলাম। সেখানে নদী আছে। সেটা হলো ফুলঝোড় নদী। সেই নদীর পাশেই যাওয়ার পরপরই একজন বলল, এখানে রাজাকাররা ক্যাম্প বসাইছে। এখান দিয়ে তো আপনারা যাইতে পারবেন না। তাইলে কি হবে? একমাত্র নদী সাঁতরে পার হতে হবে। তারপর ওপার যেতে হবে। আমাদের পরনে ছিল একটা করে লুঙ্গি । একটা করে জামা আর একটা করে গামছা। আর কিছুই ছিল না। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা নদী পার হবো। রাজাকার ক্যাম্প থেকে অন্তত আধা মাইল দূরে গিয়ে বিকাল বেলা নদী সাঁতড়ানো শুরু করলাম। নদী সাঁতরাতে সাঁতরাতে হয়রান হয়ে গেছি। রাত হয়ে আসছে। তখন খুব ক্লান্ত । আমি তো এমনিতে অসুস্থ ছিলাম জ্বরে। উঠার পরে মনে হলো গা হাত পা একদম শেষ। সারাদিন খাইনি। এক বাড়িতে একটু মুড়ি খেয়েছিলাম চেয়ে নিয়ে। তো চলে গেলাম সেই অবস্থায়, গা হাত পা মুছে সেই হিন্দু বাড়িতে গেলাম।
# আবুল বাশার, ভাইস প্রেসিডেন্ট, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা।
# সিনিয়র স্টাফ রিপাের্টার।
তৃতীয় পর্ব বুধবার প্রকাশিত হবে।
আরও পড়ুন : পর্ব – ১ : আমি স্বাধীন দেশ ও পতাকা দিতে পেরেছি কিন্তু গণমানুষের মুক্তি আসেনি : আবুল বাশার
আরও পড়ুন : আসলে একাত্তর সালের সময়টা মুখের কথায় বর্ণনা করা অত্যন্ত কঠিন : কামাল আহমেদ
আরও পড়ুন : রাজাকার যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তখন খুব খারাপ লাগে : আব্দুস সামাদ তালুকদার
আরও পড়ুন : আমাদের মতো মানুষের কাছে একাত্তরের স্মৃতি বিবিধ : আফসান চৌধুরী
আরও পড়ুন : রেডিওতে পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর শুনে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই : সাইফুল ইসলাম