ড. ইকবাল হুসাইন
ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জন নেহায়েত কম নয়। দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭০ শতাংশ। ছেলেমেয়ের সমানানুপাতে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে ৩৫ কোটিরও বেশি নতুন বই পৌঁছে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায়ও আমাদের অগ্রগতি কম নয়। গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ছয়টি। বর্তমানে দেশে 45টি পাবলিক এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নানামুখী সঙ্কট এবং সামীবদ্ধতাকেও অস্বীকার করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো মানের গবেষণা ও প্রকাশনার অভাব এবং আন্তর্জাতিক র্যাংকিংএ স্থান না পাওয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, পদ-পদবীর জন্য শিক্ষকদের ছোটাছুটি, তোষামোদি নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য-কোর্স নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি পাল্টা-যুক্তি পরিলক্ষিত হলো। কিন্তু যা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই তাহলো আমরা বিশ্বমানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পারিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চশিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করা। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মানব কল্যাণে অবদান রাখতে না পারলে কখনো উচ্চশিক্ষার মূল আদর্শ বাস্তবায়িত হতে পারে না। আমরা মূলত এখানেই পিছিয়ে আছি। ভালো মানের গবেষণা ও প্রকাশনা ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, সুযোগ-সুবিধা এবং প্রণোদনার অভাব। আধুনিক ও উন্নত ল্যাবরেটরি এবং ভালো মানের গবেষকেরও অভাবও এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষক/গবেষক বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছেন। কিন্তু নানাবিধ কারণে আমরা তাদেরকে ধরে রাখতে বা ফিরিয়ে আনতে পারছি না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক গবেষণা প্রকল্প থেকে একটি/দু’টি প্রকল্পও কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করে তবে তা সমাজ ও মানব কল্যাণে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। এ মানসিকতা নিয়েই গবেষণায় অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোশকতা প্রদান করা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে গবেষণার এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। ফলে আমাদের গবেষণা ও প্রকাশনা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারছে না।
পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রেই জাতীয় চাহিদার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। নতুন নতুন যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেখানেও বিভাগ, কোর্স, কারিকুলামে পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। গতানুগতিক কোর্স, কারিকুলাম ও সিলেবাস দক্ষতাসম্পন্ন গ্রাজুয়েট তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সারাবিশ্বই এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জ্বরে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে প্রচলিত জনশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশ চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স এবং উন্নত প্রযুক্তির দখলে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক!
১৭ কোটি মানুষের এই দেশে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ তরুণ অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণ করছেন। কিন্তু এদের একটি বড় অংশই জব-মার্কেটে নিজের প্রত্যাশিত যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মান রক্ষায় অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসমূহের দায় আরো অনেক বেশি। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ভালো নয়। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি এবং কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার বিপুল ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজগুলোতে গণহারে অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেক কলেজেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, লাইব্রেরি নেই, নেই দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী। তবুও বিস্ময়করভাবে অনুমোদন পেয়ে এগুলো ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ হয়ে গেছে! এসব কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর না আছে বিষয়গত জ্ঞান না আছে বৃত্তিমূলক জ্ঞান বা কারিগরি দক্ষতা। অথচ এদের অনেকেই প্রথম শ্রেণির সমমানের সিজিপিএ পেয়ে বসে আছে! দেরিতে হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কলেজগুলোতে নতুন করে অনার্স প্রোগ্রাম না দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে।
বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা বিবেচনায় মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসতে চান না। একসময় বিসিএস প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় চলে আসতেন। কিন্তু এখন এটি অবিশ্বাস্য। মেধাবী শিক্ষক ও মানসম্মত শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিওন থেকে শুরু করে উপাচার্য নিয়োগ সবকিছু রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও এর বাইরে নয়। অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধাবীরা ছিটকে পড়েন। ফলে শিক্ষকতার পেশাটিই ক্রমশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। একটি জাতির জন্য এটি এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের অশনিসংকেত! শিক্ষক-রাজনীতি এবং বিভিন্ন পদ-পদবির জন্য দৌঁড়ঝাপ, তদবির, তোষামোদি, অন্তর্দ্বন্দ্বও শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি, কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজশ, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, মাস্তানি মানসম্মত শিক্ষাদানকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
কিন্তু এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। পরিসংখ্যানের পিছনে না ছুটে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা জরুরি। কেবল জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা নয়, দেশ-বিদেশের শ্রমবাজারকে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষতামূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ জরুরি। উচ্চশিক্ষার স্তরে তিন বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রিকে (পাস-কোর্স) সম্পূর্ণভাবে দক্ষতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। বর্তমানে বাধ্য না হলে কেউ পাস-কোর্স পড়তে চান না। গবেষণায় দেখা গেছে, পাস-কোর্স উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দক্ষতামূলক জ্ঞানের ঘাটতি এবং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া। শিক্ষার এ স্তরে প্রযুক্তি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে আর ‘শিক্ষিত বেকার’ তৈরি হবে না। অল্প সময়ে (তিন বছর) শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ নিতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও পাস-কোর্সে আগ্রহী হবেন। দক্ষ এই মানবসম্পদ সম্মানজনক পেশায় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত করার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে যারা তাদের শিক্ষা জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে চান তারা ৪/৫ বছর মেয়াদি অনার্স প্রোগ্রামে পড়শোনা করবেন। সীমিতসংখ্যক আসনে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় শীর্ষ মেধাবীরাই এ সুযোগ লাভ করবেন। মাস্টার্স এবং এম.ফিল, পি-এইচ.ডি’র পড়াশোনা হবে আরো প্রতিযোগিতামূলক, ব্যয়বহুল এবং গবেষণানির্ভর। শিক্ষকতা, গবেষণা, এবং নীতিনির্ধারণসহ সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন বিশেষায়িত পেশায় এদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। মেধাবী এসব উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের শিক্ষা জীবন যেমন দীর্ঘায়িত, ব্যয়বহুল এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল, তেমনি যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের কর্মজীবনও হবে সুযোগ-সুবিধা, প্রোণোদনা ও মর্যাদার দিক থেকে আকর্ষণীয়।
আমাদের দেশে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আগামী দুই দশকে এসব প্রকল্পের কোনো কোনোটি অর্থহীন বলে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। কোনো দেশে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা আছে কিন্তু ওই দেশটি অনগ্রসর- এমন নজির নেই। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে দক্ষতার উন্নতি না হলে আমাদের দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। বিপর্যয় এড়াতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন অপরিহার্য। এ জন্য কেবল জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যথেষ্ট নয়; দুর্নীতি ও অপরাজনীতির প্রভাবমুক্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি।
# লেখক, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
ihusain1979@gmail.com,
আরও পড়ুন : আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি, রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে : ড. শেখ বাতেন
লাল সবুজের কথা ডটকম এর ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা