ফজলুল বারী ঃ আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ভাইকে আবার মনে পড়ছে। এক যুগেরও বেশি আগে তিনি আমাকে হাসতে হাসতে একদিন বলেছিলেন, দেশেতো শেখ হাসিনা ছাড়া কোন রাজনীতিবিদ নেই। তিনি কিছুদিন পরপর একটি রাজনৈতিক চাল চালেন। সেটি নিয়ে আমরা নাচি। এভাবে নাচতে নাচতে আমরা টায়ার্ড হয়ে গেলে আমরা আবার একটি চাল চালেন! খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত তেমন একটি ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। করোনা ভীতি নিয়ে দেশের মানুষের যখন জেরবার অবস্থা, তখন শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্ত হঠাৎ দেশের মানুষের চিন্তার মোড় ঘুরিয়েছে! খবর শুনে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন পর্যন্ত গদগদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন!
এই কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মূলত বিদেশ থেকে ফেরা সহ নানা ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে বা সরকারের চিন্তাভাবনা জানাতে যান। এবার সবাই মনে করেছিলেন এটি দেশের করোনা পরিস্থিতি, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বাতিল সহ এমন নানাকিছুর বিষয়ে বাতচিত! অতঃপর স্পষ্ট হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে খালেদা জিয়ার মুক্তির আইনগত দিক নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন।
এবং সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘোষনায় জানা গেলো আরেকটি তথ্য। তাহলো, খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম, বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মানবিক কারনে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদন করেছিলেন। এমনও হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অথবা তাদের কাছে এমন বার্তা পৌঁছানো হয়েছিল যে তারা এভাবে আবেদন করলে সরকার খালেদার মুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করবে।
উল্লেখ্য এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় এর আগে নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এতিমখানা প্রতিষ্ঠার জন্যে বিদেশ থেকে টাকা এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে। সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিল থেকে সরিয়ে ব্যক্তিগত তহবিলে নেয়া হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই এতিমখানা হয়নি। এই মামলার সময়ে বিএনপি বলেছিল সেই টাকা ব্যাংকে জমা আছে। সুদে আসলে সেই টাকা অনেক হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত একাউন্টে কেনো থাকবে সে জবাব তারা কখনো দিতে পারেনি।
এই মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন হাইকোর্টে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে একাধিকবার। জামিন নিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের এজলাসে বিশেষ একটি পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে বুঝেছেন এতে কোর্ট বিরক্ত হয়। জামিন হয়না। দুটি মামলার সাজা নিয়ে জেলখাটছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। এখন মুক্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের মতো করে। বিএনপির মতো করে নয়। বিএনপি বারবার বলে আসছে এসব রাজনৈতিক মামলা। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। বারবার শুধু অভিযোগ করেছে, সরকার এই দেয়না সেই দেয়না। অথচ দেশের মানুষ জানে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে সরকার সব দেয়। কোটা আন্দোলনকে দিয়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের বাচ্চাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়েছে।
কিন্তু পরিবারের কান্নাতো আলাদা। প্রতিবার দেখা করে ফিরে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম মিডিয়াকে বলেছেন সাবেক পরিস্থিতির অবস্থা খারাপ। খালেদা জিয়ার যে বয়স, তাঁর যে সব রোগ, তাঁর যে জীবন ছিল, সঙ্গে ফাতেমা থাকুক না কেনো খালেদার অবস্থা ভালো থাকার কথা ছিলোনা। এরমাঝে ডাক্তারদের সঙ্গে ডাক্তারি করে তিনি আর্থাইটিজের এডভান্স ট্রিটমেন্টের অনুমতিও দেননি। এতে করে তাঁর অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো। বোন সেলিমা বারবার তাকে মানবিক কারনে মুক্তি দেবার আবেদন করছিলেন। সরকার প্যারোলের কথা বলে আসছিল। প্যারোল না জামিন এতেই আটকে ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তি।
এরমাঝে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানবিক কারনে ছয় মাসের জন্যে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি। শক্ত হচ্ছে খালেদা জিয়া বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। বিদেশ যেতে পারবেননা। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেই তাকে চিকিৎসা নিতে হবে। শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি হলেও বাড়ির পরিবেশে থাকতে পারলে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার নাটকীয় অগ্রগতি হবে। পছন্দের ব্যক্তিরা তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারবেন। এবং এভাবে তাঁর প্রকৃত শারীরিক অবস্থা জানা যাবে। করোনা পরিস্থিতির কারনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতও এখন সীমিত থাকবে।
খালেদা জিয়ার যে বয়স, এই বয়সে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বেশি হলে তাকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকির মধ্যেও ফেলে দেয়া হবে। বিএনপির মহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও করোনা পরিস্থিতির উল্লেখ করে মঙ্গলবার রাতে দলের নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বা খালেদা জিয়ার বাসার আশেপাশে ভিড় না করতে বলেছেন। খালেদার শর্ত সাপেক্ষ মুক্তি নিয়ে বিএনপি নেতারা তাৎক্ষনিক নানা প্রশ্ন তুলেছেন। এটা তুলতেই পারেন। এর একটি হচ্ছে খালেদা জিয়া কেনো বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে পারবেননা। হয়তো একদিন এ শর্তও শিথিল হবে। কিন্তু বড় একটি বাস্তবতা এ অবস্থায় খালেদা জিয়া সহজে বিদেশেও যেতেও পারবেননা। করোনা পরিস্থিতির কারনে দুনিয়ার দেশে দেশে এখন দুয়ার বন্ধ। সহজ বিমান চলাচলও উন্মুক্ত নয়। শর্ত সাপেক্ষ মুক্তি কবুল করা খালেদা জিয়ার দেশে-বিদেশে নানান যাতায়াত সহ নানাকিছুর লাগাম থাকবে সরকারের হাতে। তাঁর মুক্তির সিদ্ধান্ত শুনে সব ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক থাকবে কিনা তা দেখতে আগামী ৪৮-৭২ ঘন্টা গুরুত্বপূর্ন। প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক থাকলে অনেক শর্তও সহজ হতে পারে। খালেদা জিয়া মুক্ত হলে তিনি কেমন থাকবেন তা খালেদা জিয়ার ওপরই নির্ভর করবে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা