মোশরেফা মিলি
আজ থেকে ৩৭ বছর আগের কথা। বাবার চাকুরির সূত্রে আমাদের বাস দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলা। যখনকার কথা বলছি তখনো সেটি উপজেলা হয়ে উঠেনি। বাবা কাহারোল থানার সার্কেল অফিসার তাই আমরা তখন পুনর্ভবা নদীর তীরে কাহারোল থানা কাউন্সিল কলোনীতে থাকি।
তখনকার সময় কেবলি বিদ্যুৎ গিয়েছে থানা সদরে। বাবা যখন বদলি হয়ে এখানে যান তখন থানার প্রথম টেলিভিশনটি ছিল আমাদের। মনে পড়ে আমরা এখানে আসার পর সেই ২১ ইঞ্চি ফিলিপস সাদাকালো টিভিটি আমাদের বাসার দ্বিতীয় তলার বেলকুনিতে চালু করে দেয়া হতো আর এক এক দিন এক এক ইউনিয়ন, এক এক এলাকা থেকে লোকজন আসতো টেলিভিশন দেখতে। মাঠ ভর্তি সেই লোকেরা কতটা কি দেখতে পেতো সে এক বিরাট প্রশ্ন বটে! প্রায় মাস ২ এরকম চলায় আমরা ছোটরা অনেকটাই বিরক্ত ছিলাম। প্রথম টিভি দেখার চেয়ে প্রথম বিদ্যুৎ দেখে অনেকেই আগুন লেগেছে ভেবে দৌড়ে পালাতো।
আস্তে আস্তে মাঠে টিভি দেখা কমে আমাদের বেডরুম ভর্তি হয়ে লোকজন টিভি দেখা শুরু করলো। সেটাও কমে আসলো ধীরে ধীরে। তবে ছুটির দিনে বাংলা সিনেমা আর টারজান দেখতাম কলোনীর সবাই মিলে আমাদের বাসায়। সে এক মধুর স্মৃতি। কতো মজার কাহিনীই না জমা আছে স্মৃতিতে সেসব দিনগুলির!
যারা কলোনিতে থেকেছেন তারা মাত্রই জানেন, কলোনির জীবন কতটা মজার, কতটা আনন্দের! আর কতটা ভালোবাসার! ধীরে ধীরে সবার মধ্যে এক নামহীন গভীর বন্ধন তৈরি হয়। তো সেই বন্ধন সূত্রেই লেগে থাকতো দাওয়াত, পিকনিক এসবের।
এর বাইরেও সবচেয়ে মজা ছিলো সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাওয়া প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের জেলা সদর দিনাজপুরে।
তখন প্রায় সব বাসাতেই রেডিও ছিল। তাই সবাই আপডেট পেতেন নতুন কি ছবি আসবে সেই সম্পর্কে। কোন হলে কি ছবি চলছে তাও জানা যেত। তখন খবরের কাগজেও ছবিসহ বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয়া হতো সিনেমার ( এখন আর সেরকম বিজ্ঞাপন কেনো দেয়া হয় না তার কারণটা জানতে ইচ্ছে করছে)। এরকম বিজ্ঞাপন শুনে এবং দেখে ইতিমধ্যেই আমরা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ আর ‘সুন্দরী’ দেখে ফেলেছি মা বাবাদের সাথে গিয়ে।
সম্ভবত ১৯৮৩ সালে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি তখন মুক্তি পেল ‘লালু ভুলু’ ছবিটি। রেডিও এবং পত্রিকার কল্যানে আমরা ততদিনে বুঝি গিয়েছি এটা খুব ভালো সিনেমা তাই দেখতেই হবে।
প্রতিবারের মতো সরকারি জীপগাড়ি আর ব্যক্তিগত মোটর সাইকেল বহর নিয়ে আমরা বিশাল বাহিনী দিনাজপুর রওনা হলাম দুপুর ১২ টায়। ঢেপা নদী পেরিয়ে অনেকটা কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে, কিছুটা পাঁকা রাস্তা পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম দিনাজপুর শহরে। নিউ হোটেলে লাঞ্চ করে সবাই মিলে তিনটার শো দেখার জন্য উপস্থিত হলাম সিনেমা হলে। এতটাই ছোট ছিলাম যে স্মৃতিতে হলের নাম বা অভিনেতাদের কারো নামই মনে নেই। এটুকু মনে আছে প্রধান দুই চরিত্র অর্থাৎ লালু ও ভুলু চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিল তারা কেউই পরিচিত অভিনেতা নয়।
কাহিনী যতটুকু মনে পড়ে ২ প্রতিবন্ধী (একজন দৃষ্টিহীন, আরেকজন পাহীন) তরুণের জীবন সংগ্রাম।
সিনেমা হলে দেখলাম বেশিরভাগ সময়ই মা খালাদের চোখে পানি। আমাদের ছোটদেরও বেশ মন খারাপ ছিল। বলাবাহুল্য এই সিনেমাটিই ওই বয়সেই আমাকে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সংবেদনশীল মনোভাব তৈরিতে বেশ প্রভাব রেখেছিল।
সিনেমা হলে গিয়ে আমি সর্বশেষ ছবি দেখি বরিশালের অভিরুচি সিনেমা হলে ‘ শ্রাবণ মেঘের দিন’। তখনো বরিশালে আরো ৩ টি হল ছিল- কাকলী, বিউটি এবং সোনালী। এখন শুধুমাত্র ‘অভিরুচি’ হলটিই টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
বাংলাদেশে সিনেমার অবস্থা নাকি বেশ করুণ! মধ্যবিত্ত আজ আর হলে গিয়ে ছবি দেখে না। তাই হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু মাত্র বিনোদনের উপাদান হাতের কাছে থাকা কি এ জন্য দায়ী? নাকি সিনেমা হলের পরিবেশ, ভালো মানের সিনেমা, রুচিশীল গান, গল্পে কোনো মেসেজ না থাকা, অশ্লীলতার ছড়াছড়ির জন্য মধ্যবিত্ত আজ সিনেমা হলে গিয়ে পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখার উৎসাহ বোধ করে না বরঞ্চ অস্বস্তিতে ভোগেন। আর সিনেপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখা সেটা মনে হয় শুধু উচ্চবিত্তদের জন্যই!
আশা করছি এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশি সিনেমার সুদিন ফিরে আসবে।
প্রায় ৪০ বছর পরও যেমন ‘লালু ভুলু’ র কাহিনী মনকে আন্দোলিত করে সেরকম ছবি আবারো তৈরি হবে। মনের ভিতরে বাজবে তার গান- ”তোমরা যারা আজ আমাদের ভাবছো মানুষ কী না আমরা মানুষ, ভাগ্য শুধু করলো প্রবঞ্চনা।”
# লেখক, উন্নয়ন কর্মী।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা