সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার : সরকারি-বেসরকারি ত্রান সহায়তায় আদিবাসি জনগোষ্ঠিকে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের পাঠানো এক বিবৃতিতে এতথ্য জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, কোভিড ১৯ এর চলমান প্রাদুর্ভাব আজ বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব কটি দেশ এটি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশও আক্রান্তের বাইরে নয়। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ৬২০ ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসটি একদম নতুন হওয়ায় প্রতিষেধক তৈরিতে সময় লাগছে। তাই এর নেতিবাচক ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউই বলতে পারছে না।
তিনি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই তাঁর সাধ্যমত এটিকে মোকাবিলার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন ধরণের সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সরকারের এ উদ্যোগে সামিল হয়েছে। সারাদেশে লকডাউন চলমান রয়েছে। চলমান এ লকডউনে নিম্ন আয়ের লোকেরা দুর্ভোগে পড়েছে। এমতাবস্থায় সরকার বা প্রশাসন, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদেরকে ত্রাণের ব্যবস্থা করে চলেছে। এটি খুবই প্রসংশনীয়।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমরা জানি, দেশে প্রায় চল্লিশ লক্ষের অধিক আদিবাসী রয়েছে। এদের অধিকাংশই গরীব ও নিম্নআয়ের মানুষ। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, পাহাড় ও সমতলের এসমস্ত প্রান্তিক আদিবাসীরা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের এসমস্ত ত্রাণ সহায়তার আওতার বাইে অনেকেই থেকে যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী অঞ্চল বা গ্রামে লকডাউনে দুর্ভোগের খবর জানতে পেরেছি। যেমন-
নালিতাবাড়ী, ধোবাউড়া, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, মধ্যনগর ও তাহিরপুর থানার বেশ কিছু হাজং ও বানাই গ্রামের শতাধিক পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে । উক্ত অঞ্চলের অধিকাংশ হাজং ও বানাই জনগণ দিনমজুর শ্রমিকের কাজ করে। লকডাউনের ফলে বর্তমানে তাদের কাজ স্থগিত হয়ে পড়লে তাদের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনবেলার খাবার এখন কোন কোন হাজং ও বানাই পরিবারের সদস্যরা একবেলা খাওয়ার পরও তাদের সামান্য খাদ্য মজুদটুকুও শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাজং ও বানাই পরিবারগুলো এখন একদিকে রোগের আশংকা অন্যদিকে খাদ্য সংকটের চরম দূর্ভোগের কথা আশংকা করছে।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কমপক্ষে ১৩টি জেলায় ৩৮টিরও অধিক প্রায় ১৫ লক্ষাধিক আদিবাসী জাতি যেমন: সাঁওতাল, উরাও, মুন্ডা, মাহাতো (বেদিয়া/কুড়মি), মালো, মাহালে, মুষহর, কড়া, কোডা, কোল, ভিল, ভুঁইমালি, বাগদী, তুরি, গঞ্জু, গড়াইত, তেলি, কোচ, কন্দ, রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হো ইত্যাদি জাতিস্বত্তার বসবাস। ভূ-সন্ত্রাস বা জমি জালিয়াতির কারনে এইসব জাতিস্বত্তার ৯০ শতাংশই আজ ভূমিহীন যাদের নিত্যদিনের খরচ দিনমজুরীর টাকায় মেটাতে হয়ে। দিনমজুরী শেষে সেই টাকায় নিত্যদিনের চাল, ডাল, তেল, লবন কিনে তারা বাড়ি ফিরে সেটা রান্না করে পরিবারের জীবন নির্বাহ করে। ফেব্রুয়াারি-মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে অধিকাংশ আদিবাসী কৃষি শ্রমিকদেরই হাতে কাজ থাকে না। অন্যের কৃষি জমিতে নিড়ানি, সার-লাগানো, চারা পরিচর্যা ইত্যাদি কাজ করেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে দেশে লক-ডাউন পরিস্থিতিতে তারা হয়ে পড়েছে কর্মহীন। এ অবস্থায় আদিবাসীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে জংলী আলু, কচু শাক, শামুক-ঝিনুক-কুচিয়া-কাঁকড়া সংগ্রহ করে জীবিকা-নির্বাহ করছে। আদিবাসী কৃষি শ্রমিকেরা ইতোমধ্যে চড়া সূদে মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন/আগাম শ্রম বিক্রি’ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে এবং নামমাত্র টাকা দরে আগাম বরো ধান কাটার চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে। যা তাদের জন্য বরাবরই আত্মঘাতী। কারণ মৌসূমের ফসল উঠা মাত্রই ঋণ মহাজন ও চাল ব্যবাসায়ীরা দ্বিগুণ ও তিনগুণ দরে সেই কর্জ সুদে-আসলে আদায় করবে। এতে করে আদিবাসীরা দিনকে দিন আরো নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়বে। যার ফলে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আদিবাসীদের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর আদিবাসী পরিবারগুলো খাদ্যের অভাবে চরম দূর্ভোগে পড়বে।
তিনি বলেন, গাইবান্ধায় প্রায় ১২০০টি সাঁওতাল পরিবার ও রাজশাহীতে ২০০০টি সাঁওতাল, পাহাড়ীয়া ও ওড়াও পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় বিভিন্ন পাড়া যেমন- বাগান পাড়া, পশ্চিম টালি পাড়া, শেখ পাড়া, মোল্লা পাড়া, আলীগড়, মিয়াপুর, কলিমনগর, পবা নতুন পাড়া, বড় বন গ্রাম শেখ পাড়া, রওদাপাড়া কুসর সেন্টার, কইকুরি, হলদিবোনা, সন্তোষপুর, গোপালপুর, আন্ধ্যারকোঠা পাড়া। এ সমস্ত গ্রামে সাঁওতাল, পাহাড়ীয়া ও উড়াওদের ২০০০টি পরিবার বসবাস করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ দিনমজুর করে দিনে আনে দিনে খায়, কেউ রিক্সা-ভ্যান চালায়, কেউ কেউ কৃষি শ্রমিক। তারা সবাই কোভিড-১৯ এর লকডাউনে ঘরবন্দি ও কর্মহীন হয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাদের যেটুকু সঞ্চয় ছিল তাও শেষ বা শেষের পথে। তারা এখনও সরকারি ত্রাণ সহায়তা পায়নি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তিন গ্রামের প্রায় ১২০০ সাঁওতাল পরিবার করোনার লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে- কুয়ামারা, মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া। জানা যায়, করোনা আতঙ্কে এ তিন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে বসে আছেন। তারা প্রশাসনের কাছ থেকে কোন ধরণের সাহায্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা অভিযোগ করেন- পুলিশ প্রশাসন ও রংপুর চিনি মিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষের পর থেকেই স্থানীয় সরকার তাদের কোন সহায়তা করে নি। সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতালরা অভিযোগ করেছেন, তারা এখনও কোন ত্রাণ সহায়তা পাননি।
সিলেটের অধিকাংশ চা-শ্রমিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর। তারা গরীবের চাইতেও গরীব। এ অবস্থায় তারা খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এয়াড়াও শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট ইউনিয়নের ৩৫টি গারো পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক দরিদ্র মানুষ কঠিন অবস্থায় দিন যাপন করছে।
কক্সবাজারের চাকমা, তনচংগ্যা, রাখাইন এবং চাদপুরের ত্রিপুরা ও খুলনা-সাতক্ষীরার আদিবাসীরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের মধ্যে যারা দিনমজুর, গরীব কৃষক ও প্রান্তিক জুম চাষীদের অবস্থা খুবই নাজুক। তারাও এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। কোভিড ১৯ প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি হামের নতুন প্রাদুর্ভাব তিন পার্বত্য জেলাকে বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখেছে।
এছাড়াও, দেশের বিভিন্ন প্রান্তথেকে শতশত আদিবাসী পরিবার জিবীকার প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড়বড় শহর গুলোতে যেমন, চট্টগ্রাম, সিলেট, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য শহরগুলোতে। যাদের বেশিরভাগ বিভিন্ন নিম্ন আয়ের পেশার সাথে যুক্ত। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে শত শত মানুষ বিউটি পার্লার, বাসাবাড়ী, দারোয়ান, ড্রাইভার ইত্যাদি পেশায় কাজ করছে যাদের বেশিরভাগ চাকুরী হারিয়েছেন। এই পরিবারগুলো এখন মানবেতর জিবন যাপন করছে।
এমতাবস্থায় আমাদের আহ্বান, এসমস্ত প্রান্তিক ও দরিদ্র আদিবাসীদের ঘরে ঘরে সরকারি ত্রাণ সহায়তা যেন অনতিবিলম্বে পৌঁছায়। পাশাপাশি অন্যান্য দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের মানবিক সহায়তার জন্য আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা