আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
বিজয়ের মাসে আমরা আসলে তখন আগরতলায় ছিলাম। ত্রিপুরার আগরতলার ক্যাম্পে আমরা রোগী দেখতাম। যেদিন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় সেদিন আমরা আগরতলা থেকে পেছনের দিকে সরে একটু ভিতরে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছিলাম। কারণ তখন এদিকে বোমা পড়ছিল। ভিতরের দিকে গিয়ে কয়েকদিন ছিলাম। এরপর ২/১ দিনের মধ্যেই কুমিল্লা থেকে আর্মিরা সরে যেতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা এবং যৌথবাহিনী প্রথমদিকেই কুমিল্লামুক্ত করতে সক্ষম হয়। তাই, আমাদের এদিকে আর তখন তেমন ভয় ছিল না। কিন্তু যেহেতু আমাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চাকাচ্ছা ছিল তাই আমাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়েছিল। আগরতলাতে সম্ভবত একদিনই বোমা ফেলা হয়েছিল। এরপর কুমিল্লার এদিকে আর তেমন কোন সুবিধা করতে পারেনি পাকিস্তান আর্মি। তারা বাধ্য হয়ে পিছু হটে যায়।
আমরা যেহেতু ক্যাম্পে চিকিৎসা করতাম, আমাদের কাছে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরণের খবর আসত। এসময় বেশ কিছু আহত লোকজন আমাদের ক্যাম্পে আসছিল। ১৫ তারিখে আমরা লোকমুখে খবর পাওয়া শুরু করলাম, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়ে। আমরা জানতে পারলাম, দেশের অনেক রত্নকে হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে আমার দুজন খুবই প্রিয় মানুষ ছিলেন, তাদের মৃত্যুর খবর পেলাম। এরমধ্যে প্রফেসর ফজলে রাব্বী, তিনি কার্ডিওলজিস্ট ছিলেন। তিনি সরাসরি আমার শিক্ষক। আমি যা কিছু মেডিসিনের বিষয় শিখেছি তার সবটুকু তার কাছ থেকে শিখেছি। আমি স্টুডেন্ট থাকার সময়ে শিখেছি। এরপর ইন্টার্নি করার সময় তার কাছ থেকে শিখেছি। এরপরে আমি যেটুকু মেডিসিনের শিক্ষা পেয়েছি সবটাই তার কাছে। সেই শিক্ষকের মৃত্যুর খবর পেলাম ১৬ তারিখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমার আর একজন শিক্ষক ডা. আলীম চৌধুরী, চক্ষু বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর শুনলাম। তো, এই দুটো ব্যাপারে আমাদের মনে খুব কষ্ট ছিল। একদিকে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করছে। সেই খবর পাচ্ছি, খুব আনন্দ হচ্ছে। অন্যদিকে, তাদের দুজনের মৃত্যু আমাদের কষ্ট দিচ্ছে। এদিকে, রেডিওতে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন যায়গার পতনের খবর পাচ্ছিলাম। এই বুদ্ধিজীবী নিধনের খবরে আমাদের সেই আনন্দ অনেকটাই মলিন হয়ে যায়।
যুদ্ধে আমার পরিচিত অনেক মানুষ মারা গেছে। এনিয়ে আমাদের মধ্যে নিত্যদিন উৎকণ্ঠা ছিল। ১৪ ডিসেম্বর শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। বিজয়ের পরে রায়েরবাজারে, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটে তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেছে। বিজয়ের পরই তাদের এই খবরগুলো বেরিয়ে আসতে লাগল। তখন আমাদের কাছে বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে এই মানুষগুলোর মৃত্যু বিশাল এক বোঝা হয়ে পড়ল। এমনিতেই আমাদের মন খারাপ থাকত। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা দেশে আসতে পারছিনা। এরপরে একটার পর একটা মৃত্যু সংবাদ আমাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিল। এগুলো সহ্য করা খুবই কষ্টকর ছিল।
বিজয়ের আনন্দ ছিল ১৬ই ডিসেম্বর, এরপর বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে, যেহেতু আমরা দেশে নাই, তাই একইসঙ্গে এতগুলো মানুষের মৃত্যু আমার মধ্যে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল।
আমি দেশে ফিরলাম ৩০ ডিসেম্বর। আমাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চা। তখন রাস্তার মধ্যে পাকিস্তান আর্মিরা স্থলমাইন পুঁতে রেখেছিল তাই, যাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চা ছিল তাদেরকে রাস্তাটা নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত দেশে আসতে দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যে একটা বিজয় উল্লাস ছিল সেটার পাশাপাশি আমার দুই প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যু আমাকে পুরো বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। আমি দেশে আসলাম যখন তখণকার পরিস্থিতি খুবই আনন্দের ছিল। তবে, আমি মানুষের উল্লাস দেখেছি, ১০ ই জানুয়ারি। যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেন। তখন যে মানুষের মধ্যে আনন্দ উল্লাস দেখলাম, আমার কাছে মনে হয় এটা বিজয়ের আনন্দের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
আমি সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিনি। আমি যেহেতু নিজে মহিলা পরিষদের সদস্য ছিলাম, ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে ছিলাম তাই আমি ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে যে মানুষকে সেবা দিয়েছি সেটাই আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। এসময় আমাদের সঙ্গে অনেক মানুষ ছিল। আমি ক্র্যাফ্টস হোস্টেলে সেবা দিতাম। এখানে ৪৫০-৫০০ মানুষ থাকত। যারা বয়সে তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তারা এখানে এসে থাকত। পরে তাদেরকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হতো, ট্রেনিং দেয়ার জন্য। আমি ক্র্যাফ্টস ক্যাম্পের পাশাপাশি বর্দুয়ালি ক্যাম্পে ডাক্তারি করি। আমার সঙ্গে চিকিৎসক টিমে ছিলেন চট্টগ্রামের দ্বীপান্তরে নির্বাসিত নেতা অমঙ্গ সেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে আন্দামানে দ্বীপান্তরে ছিলেন। পরে, ব্রিটিশ চলে যাবার পর ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। উনি কম্পাউডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আমার সঙ্গে কাজ করতেন। আমি ছোট্ট একটা মেয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে উনার কোন হেজিটেশন দেখিনি। উনি কাজটাকেই ভালবাসতেন। আমি অস্বস্তি অনুভব করতাম কিন্তু উনার কোন অস্বস্তি ছিল না। এটাই আমার জীবনের বড় শিক্ষা।
মানুষ যখন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হয় তখন সে আর দেখে না যে, সে কিভাবে দেশের জন্য কাজ করছে। এটা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি যে, দশকে ভালবেসে, কে কিভাবে কাজ করল সেটা বড় কথা নয়, দেশের জন্য সে কাজ করছে সেটাই বড় কথা হওয়া উচিত।
# ডা. মাগদুমা নার্গিস রত্না, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগরতলা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারি চিকিৎসক।
তাসকিনা ইয়াসমিন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, লাল সবুজের কথা ডটকম।
আরও পড়ুন : আমাদের মতো মানুষের কাছে একাত্তরের স্মৃতি বিবিধ : আফসান চৌধুরী
লাল সবুজের কথা ডটকম এর ফেসবুক পেজ ভিজিট করুন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা