আশীষ কুমার দে
একটি দুর্ঘটনার রেশ না কাটতেই মাত্র ৩৬ ঘন্টার ব্যবধানে আজ আরো একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলো। বিকেল ৩টার দিকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া রেলস্টেশনে ঢাকা থেকে রংপুরগামী ট্রেন ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ দুর্ঘটনাকবলিত হয়। এতে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইঞ্জিন ও সামনের তিনটি বগিতে আগুন ধরে যায়।
আজকের দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর এখনও পাওয়া না গেলেও ৫-৬ জন আহত হয়েছেন এবং তাদেরকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুজ্জামান আরিফ (সূত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন, তারিখ: ১৪ নভেম্বর, ২০১৯)। তবে প্রাণহানি না ঘটলেও সার্বিক বিবেচনায় এ দুর্ঘটনাটিও ভয়াবহ।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) রাত পৌণে ৩টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ স্টেশনে ‘তুর্ণা নিশীথা’ ও ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’ নামের দু’টি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা শ’য়ের কাছাকাছি।
বেদনাদায়ক ঘটনাটির পর দেশের সচেতন নাগরিকরা যখন নিরাপদ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার, গণমাধ্যমগুলো যখন এককালের জনপ্রিয় এই যোগাযোগ ব্যবস্থার বর্তমান ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি সরকারসহ জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্রিয়, তখনই ঘটে গেলো আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
কিন্তু বারবার কেনো এমন দুর্ঘটনা- এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মনেও। কারণ, এ ভূখ-ে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। এমনকি পাকিস্তান শাসনামলের শেষদিকেও ষাটের দশকজুড়ে (১৯৫৯-১৯৭০) সাধারণ মানুষের আরামদায়ক বাহন ছিল ট্রেন; যার ধারাবাহিকতা স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক বছরও চলেছে।
তবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অতীত গৌরব হারাতে থাকে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পঁচাত্তর-পরবর্তী অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কুপরামর্শে বহুজাতিক অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করে। বৈদেশকি ঋণে নতুন নতুন সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণের মহাযজ্ঞ শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় লাখ লাখ একর ফসলি ও বসতি জমি, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, উন্মুক্ত জলাভূমি ও প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংসের মহোৎসব। নদ-নদীগুলোর ওপর পরিবেশবিনাশী সেতু, কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে সেগুলো বিপন্ন করে তোলা হয়।
এই অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী কার্যক্রমের ফলে দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম নৌপথ ও রেলপথ মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নৌ পরিবহন ব্যবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় রেল পরিবহন ব্যবস্থা অগ্রগ্রণ্য ও জনবান্ধব হওয়া সত্ত্বেও এ দুটি যোগাযোগ মাধ্যমকে চরম উপেক্ষা করা হয়েছিল। যে কারণে পরিবেশবান্ধব নৌ পরিবহন ব্যবস্থার মতো রেল পরিবহন ব্যবস্থারও করুণ পরিণত হয়; যা চলতি শতকের প্রথমদিকে সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে।
রেলওয়ের সংকট উত্তরণ এবং এই মাধ্যমকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালেই উদ্যোগ নেয় এবং ২০১১ সালে পৃথক রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করে। এর আগে আমাদের রেল পরিবহন ব্যবস্থা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের (বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়) অধীনে একটি বিভাগ ছিল; যার নাম ছিল ‘রেলওয়ে বিভাগ’।
শুধু পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন নয়, রেল পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য নানামুখি উদ্যোগও নেয় সরকার। ২০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে এর অধীনে ছোটবড় মিলিয়ে ২০টি প্রকল্পও (চলমান মেট্রোরেল প্রকল্প এর আওতাভুক্ত নয়) হাতে নিয়েছে সরকার। এ পর্যন্ত এসব প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। সূত্র : ভোরের কাগজ, তারিখ: ৬ জানুয়ারি, ২০১৯।
রেলওয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহিত প্রকল্পগুলোর কয়েকটি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, বাকিগুলো চলমান রয়েছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও গত এক দশকে রেল পরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বরং বারবার দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে রেলওয়ে জনবিব্রতকর হয়ে পড়ছে। ফলে রাষ্ট্রীয় সেবা সংস্থাটি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার কাঙ্খিত উন্নয়ন গত ১০ বছরে কেনো হলো না- এ প্রশ্নের উত্তর জানা এখন অতিজরুরি হয়ে পড়েছে। অলাভজনক বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য উঠে এসেছে; যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো তথা সরকারের গাফিলতির বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. সারা দেশে রেলপথে লেভেল ক্রসিংয়ের (রেলক্রসিং) সংখ্যা ২,৪৯৭; যার মধ্যে বৈধ ক্রসিং ১,৪১২টি ও অবৈধ (রেলওয়ে বিভাগের অনুমতি ছাড়া স্থাপিত) ১,০৮৫টি। বৈধ ক্রসিংগুলোর মধ্যে বেরিয়ার ও গেটকিপার আছে ৪৬৬টিতে। অবৈধগুলোতে কোনো বেরিয়ার ও গেটকিপার নেই। এই হিসেবে বৈধ- অবৈধ মিলিয়ে ২,০৩১টি অর্থাৎ ৮১ দশমিক ৩৩ শতাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এবং এসব ক্রসিংয়ে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
২. রেলওয়ে বিভাগের মোট লোকোমোটিভের (রেলইঞ্জিন) সংখ্যা ২৬২; এর মধ্যে ২০৬টির অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ৭৮ দশমিক ৬২ শতাংশ রেলইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ; যা রেল চলাচল ব্যবস্থাকে দুর্বল, ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
৩. ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়কালে কর্মকর্তা, কর্মচারি ও শ্রমিক মিলিয়ে রেলওয়ে বিভাগে ৫৬ হাজার জনবল ছিল। আর তখন দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। সেই জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চাপ অনেক বেড়েছে। কিন্তু রেলওয়ের বর্তমানে জনবল মাত্র ২৫ হাজার ৮০০; যা সুষ্ঠু রেল সেবার ক্ষেত্রে মস্তবড় বাধা।
৪. রেল আইন অনুযায়ী, রেললাইনের দু’পাশে ২০ ফুট জায়গা থাকবে সংরক্ষিত, যেখানে কোনো ধরণের স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু খোদ রাজধানীসহ সারা দেশে রেললাইনের পাশ ঘেষে গড়ে তোলা হয়েছে কাঁচাবাজার, বস্তি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রেললাইন সংলগ্ন জায়গা স্থায়ীভাবে সুরিক্ষত রাখতে কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
৫. সারা দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে ইজারা দেয়া রেলওয়ের হাজার হাজার একর জমির ইজারা বাতিল এবং অবৈধ দখলে থাকা সম্পত্তি উদ্ধারে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
৬. ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলেও রেল চলাচল ব্যবস্থাকে আজো আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর করা হয়নি। বিশেষ করে চলন্ত ট্রেনসহ রেলস্টেশনগুলোর সিগনাল ব্যবস্থাকে এর আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি হলেও কর্তৃপক্ষ সে কাজটি করেনি। এ বিষয়ে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে কি-না, তাও জানায়নি কর্তৃপক্ষ।
৭. ট্রেন দুর্ঘটনা কিংবা রেলপথে অন্যান্য দুর্ঘটনার পর আইনের বাধ্যবাধকতায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদন কখনওই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় না। এমনকি মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়ে বিভাগের ওয়েবসাইটেও তা দেয়া হয় না। ফলে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ ও প্রকৃত দায়ীদের সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না সাধারণ মানুষ।
উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্নজনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আজ সিরাজগঞ্জে ও ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘটিত পৃথক ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে সিগন্যাল সংক্রান্ত ত্রুটি বা জটিলতাকেই প্রাথমিকভাবে দায়ী করা হচ্ছে।
যদিও নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে উঠে আসা সমস্যাগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি; পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশকের রাষ্ট্রীয় অদূরদর্শীতা, অবহেলা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণেই রেলওয়ের এই করুণ হাল। তবে উপরোক্ত সাতটি সমস্যার মধ্যে এতোদিনে ২ ও ৩ নম্বর সমস্যার আংশিক এবং বাকিগুলোর শতভাগ সমাধান করা সম্ভব ছিল। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি রেলওয়ের সেবার মান অনেক বৃদ্ধি পেতো।
কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কেনো করা হলো না বা হচ্ছে না এবং সেগুলো না করে কেনো হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, একটি প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে- তা ভেবে দেখা এখন অতিজরুরি হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি যদি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না নেন, তাহলে ব্্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জে ট্রেন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে এবং পরিবেশসম্মত জনবান্ধব রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার আকাঙ্খা স্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাবে। তারিখ: ১৪.১১.২০১৯ ইং।
# আশীষ কুমার দে, সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, শিপিং এন্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ)
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা