উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামত না নেয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুণর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে যেনতেনভাবে ভূমি অধিগ্রহণের প্রচলিত চর্চা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকগণ।
শুক্রবার (৩০ নভেম্বর) রাজধানীয় আগারগাঁওস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন, উচ্ছেদ, মানবাধিকার ও পরিবেশ বিপর্যয় শীর্ষক গণশুনানীর রায়ে এই নির্দেশনা আকারে এই আহ্বান জানানো হয়।
গণশুনানী অনুষ্ঠানে দেশের তিনটি স্থানের আলোচিত তিনটি অধিগ্রহণ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগের শুনানী হয়। প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চ কর্তৃক আয়োজিত এ অনুষ্ঠানের সহ-আয়োজক ছিল এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট, একশনএইড, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ।
গণশুনানীর প্রথমে কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থানে উচ্ছেদ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বিচারক প্যানেলে ছিলেন অ্যাড. সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সি আর আবরার, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী; প্রাক্তন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুশী কবির, মানবাধিকার কর্মী।
ভুক্তভোগীদের পক্ষে বাদী পক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। শুনানীতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিচারকদের সহযোগিতা প্রদান করেন টিআইবি-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফখারুজ্জামান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার।
শুনানীতে সাক্ষী হিসেবে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার স্থানীয় ভুক্তভোগী সকুন্তাজ আতিক, শাহাবুদ্দিনসহ কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা ও দাবি তুলে ধরেন। তারা অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানী, চাকুরির ক্ষেত্রে বঞ্চনা, বিকল্প কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা ও উদ্যোগের অভাব, প্রকল্পের কারণে স্থায়ী জলাবদ্ধতা, সামাজিক অসঙ্গতি ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেন।
শুনানী শেষে রায় প্রদানের সময় বিচারক প্যানেলের প্রধান অ্যাড. সুলতানা কামাল বলেন, প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি অনুসরণে বড় যে ব্যত্যয়টি ঘটে সেটি হলো- প্রকল্প এলাকার জনগণের মতামত ঠিকমত নেয়া হয় না। প্রকল্প গ্রহণে স্থানীয়দের বা জনগণের কোনো অংশগ্রহণ কিংবা অংশীদারিত্ব নেই।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের মতামত যথাযথভাবে গ্রহণ না করেই প্রকল্প নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেটি মোটেই সমীচিন হয়নি। এক্ষেত্রে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনেরও ব্যত্যয় হয়েছে, ক্ষতিপুরণ পরিশোধের আগেই অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়েছে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়দের পুনর্বাসন ও প্রকল্পের কাজে নিয়োগের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তার অনেক কিছুই পূরণ করা হয়নি।
পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ ধরণের একটি প্রকল্প গ্রহণের আগে যে ধরণের পরিবেশগত ও আর্থসামাজিক প্রভাব নিরুপণ জরুরি ছিল সেগুলো যথাযথভাবে হয়নি এবং সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য প্রকল্পের আয় থেকে দীর্ঘমেয়াদী পুণর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু ফার্ম এলাকার ভুক্তভোগী আদিবাসী সাঁওতাল ও অন্যান্যদের অভিযোগ বিষয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় শুনানীতে বিচারক প্যানেলে ছিলেন অ্যাড. সুলতানা কামাল, অধ্যাপক সি আর আবরার, এবং পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নঈম ওয়ারা। বিচারকদের সহযোগী বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন শেড-এর নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ গাইন ও অধ্যাপক আইনুন নাহার। ভুক্তভোগী বাদিপক্ষের আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন লোকমান হোসেইন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়া ও অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম।
ভুক্তভোগীদের পক্ষে শুনানীতে সাক্ষ্য দেন সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান, প্রিসিলা মুরমু, অলিভিয়া হেমব্রম প্রমুখ।
শুনানী শেষে রায় প্রদানের সময় অ্যাড সুলতানা কামাল বলেন, ভুক্তভোগীদের পুর্বপুরুষদের কাছ থেকে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু ফার্মের জন্য জমি নেয়ার সময় সরকার যে চুক্তি করেছিল সেখানে শর্ত ছিল ইক্ষু চাষ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এ জমি ব্যবহার করা যাবে না। যেহেতু এই শর্তের ভঙ্গ হয়েছে, সেহেতু এই জমি সরকার ফেরত নেবে এটাই আইনগত বিধান।
জমি ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিগুলোর ঔপনিবেশিক মনোভাব গণতান্ত্রিকা দেশে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র যখন নিজেই আইন ভঙ্গ করে কিংবা অনৈতিক আচরণ করে তখন অন্যরা দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্র নিজের সম্পাদিত চুক্তি, প্রণীত আইন ভঙ্গ করতে পারেনা। অতএব, সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের যেসব ভুক্তভোগী তাদের পুর্বপুরুষদের জমি ইক্ষু ফার্মের কারণে হারিয়েছে, রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হলো তাদের সে জমি অবিলম্বে ফেরত দেয়া।
বিনা নোটিশে গত ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে সেটির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর যেসব সদস্যরা এ সময়ে ভুক্তভোগীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেছেন, তাদের বিচার যথাযথ প্রক্রিয়ায় হতে হবে।
তিনি উচ্ছেদ হওয়া পরিবারসমূহের যথাযথ পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান, তিনি উল্লেখ করেন, আশ্রয়ন প্রকল্পে নয় তারা যাতে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনজীবিকা নিয়ে মানবিক মর্যাদার সাথে নিজেদের জায়গায় বাস করতে পারেন সেটির ব্যবস্থা করতে হবে।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিচারক প্যানেলে ছিলেন খুশী কবির, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএম আকাশ ও ভূমি ও মানবাধিকার কর্মী শামসুল হুদা। বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন বেলা-র নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ কর্মী শরীফ জামিল এবং অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা।
ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধি হিসেবে বাদী হিসেবে সাক্ষ্য প্রদান করেন, নুর-আলম, গীতা হালদার, মনীন্দ্রনাথ রায়, কমলা সরকার, হেমায়েত শেখ প্রমুখ। বাদী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারওয়াত শামীম, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম।
‘‘আগে যে মানুষগুলোর সাথে একসাথে নৌকা দৌড়াতাম, ঘোড়া দৌড়াতাম, যাত্রাপালায় যাদের সাথে নিয়মিত দেখা হতো, সেই মানুষগুলো এখন কোথায় চলে গেছে আমরা কেউ জানি না। আমাদের এলাকার মইদারা নদী, পশুর নদী থেকে মংলা পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম পাশে এখন শুধু ধুধু বালির স্তর আর জায়গায় অমুক গ্রুপ, তমুক গ্রুপের সাইনবোর্ড। তারা বিভিন্ন কৌশলে মানুষের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। এলাকায় এখন অপরিচিত মুখের ভীড়, পরিচিতরা হারিয়ে যাচ্ছে। বিকেলের পরে বাজারে গেলে বিভিন্ন কোম্পানীর লোকজনের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষটাও ঠিকমত পাই না। বিকেলের আগে নিমেষেই সব বিক্রি হয়ে যায়।” একনাগারে কথাগুলো বলছিলেন বাগেরহাটের রামপাল থেকে আসা ভুক্তভোগী মনীন্দ্রনাথ রায়।
শুনানী শেষে রায় প্রদানের সময় বিচারক প্যানেলের প্রধান খুশী কবির বলেন, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও তার জন্য কয়লা পরিবহনের ফলে সুন্দরবন ঝুঁকির মুখে পড়বে এ ধরণের বিশেষজ্ঞ মতামত, নাগরিক আন্দোলনকে তোয়াক্কা না করে সরকার এ প্রকল্প গ্রহণ করে। আমরা দেখছি এর কারণে শুধু সুন্দরবন নয় স্থানীয় জনগণও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
রামপাল প্রকল্প ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোতে ব্যাপক হারে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, গ্রুপ অব কোম্পানীজ সেগুলোকে প্রায় জোর জবরদস্তি করে কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় জনগণ, পরিবেশ, নদীকে বাঁচাতে হবে। সরকার স্থানীয়দের মতামত ও বিশেষজ্ঞদের মতামত সর্বোপরি জনমতকে শ্রদ্ধা করে পরিবেশ ও জনস্বার্থের বিরোধী প্রকল্প থেকে সরে আসবে এটিই আহ্বান।
পাশাপাশি সরকারকে দেখতে হবে যেন কোনো স্থানীয় নাগরিকের জমি , কৃষিজমি যেন কেউ দখল করে নিতে না পারে।
গণশুনানীর সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, সরকার বলেছিল রামপাল, মাতারবাড়ি প্রকল্প চালু হলে বিদ্যুতের দাম কমবে। কিন্তু আমরা সরকারি কাগজপত্রেই দেখছি আসলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেটি অগ্রাহ্য করে সরকার রামপাল, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুতের মতো পরিবেশ ধ্বংশকারি প্রকল্প অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, জনগণের স্বার্থে উন্নয়ন হোক সেটা সবাই চায়। কিন্তু যে উন্নয়নে জনগণকে মূল্য দিতে হয়, যার ফল ভোগ করে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সেটিকে উন্নয়ন কিভাবে বলা হয়? কার জন্য এই উন্নয়ন? পরিবেশ ও জনগণকে বিপদে ফেলে উন্নয়নের যে ধারা এখন চলছে তাতে দেখা যাবে যে একসময় দেশে শুধু তথাকথিত উন্নয়নই থাকবে কিন্তু জনগণ থাকবে না।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা