বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন অভিযাত্রায় যুব জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুবদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৩০ বছরের কম বয়সী সংসদ সদস্যের সংখ্যা মাত্র ০.২৯ শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশে স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে যুবদের সীমিত অংশগ্রহণের মূল কারণগুলো হলো দারিদ্রতা, স্বাক্ষরহীনতা, জেন্ডার বৈষম্যসহ, গণতন্ত্রের অভাবসহ প্রভৃতি সামাজিক-অর্থনৈতিক হুমকি। আর এক্ষেত্রে যুবদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
ইউনিয়ন পরিষদ, রাজনৈতিক দল ও জাতীয় সংসদে যুব প্রতিনিধিত্বের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য একশনএইড বাংলাদেশ ও গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটিং (জিআরএম) পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে আসে। গবেষণার তথ্যমতে, পরিবার ও সমাজ থেকে অনুৎসাহিত করাও রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ না করার অন্যতম কারণ।
শনিবার ( ২৮ ডিসেম্বর) ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে একশনএইড বাংলাদেশ ও ধ্রুবতারা ইউথ ডেভেলপমেন্ট-আয়োজিত ‘রাজিনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ কাঠামোতে যুব প্রতিনিধিত্বঃ সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক বৈঠকে গবেষণা প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তমালিকা সুলতানা।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মতে, রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের মতামত শোনা হলেও মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাই এবং অনেক ক্ষেত্রেই তরুণদের মতামতকে গ্রাহ্য করা হয় না মূল সিদ্ধান্তে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ ও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ও প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের যুবদের অংশগ্রহণের হার নির্ণয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নীলফামারি, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট- এই ছয়টি জেলার ১৮-৩৫ বছর বয়সী ২০৪ জন তরুণ-তরুণী (৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ নারী) দের উপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
এই গবেষণায় আরো উঠে আসে যে, রাজনৈতিক বিভিন্ন কমিটিতে পুরুষের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ কম। তরুণীদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে মূল বাধা হলো জেন্ডার বৈষম্য এবং ধর্মীয় মনোভাব। এছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন- দুর্নীতি, অন্যায্যতা, খুন, সহিংসতা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি তরুণ-তরুণীদের অসন্তুষ্টির কারণ।
ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়ন কর্তৃক ২০০৪ সাল থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক পরিসরে তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব একেবারে নেই বললেই চলে। যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী ৩০ বছরের কম বয়সী, সেখানে সারা বিশ্বের সংসদগুলোতে ৩০ বছরের কম বয়সী সংসদ সদস্য মাত্র ২ শতাংশ। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ৪০ বয়সের নিচে সদস্যের উপস্থিতির হার ৫.৭১ শতাংশ। পাকিস্তানে ১১.৫৪, শ্রীলঙ্কাতে ১২.৪৪, ভারতে ১৫.০১ এবং আফগানিস্তানে ২৫.৭১ শতাংশ।
বর্তমান সময়ে সরকারের ও রাজনৈতিক দলসমূহের নীতিসমূহে যুবদের প্রতিনিধিত্বের হার। জাতীয় যুব নীতি ২০১৭ তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুবদের সম্পৃক্ত করার কথা বললেও তা নিয়ে নেই কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। রাজনৈতিক দলসমূহও নিজেদের দল ও বিভিন্ন কমিটিতে যুবদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিতের কথা বললেও তা নিয়ে তাদের কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই।
রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়ন, মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবী উঠে আসে এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী যুবদের মধ্য থেকে। দেখা গেছে, জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যুবদের মধ্যে। রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে যুবদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। দক্ষ যুব নেতৃত্ব গড়ে তুলতে জ্যেষ্ঠ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহকে দক্ষ যুব নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বিনিয়োগ জরুরি।
আলোচনা বৈঠকের অন্যতম বিশেষ বক্তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান এমপি বলেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেজন্য দক্ষ ও যোগ্য রাজনীতিবিদ একটি দেশের জন্য অতি জরুরি। আমাদের দেশের যুবরা দেশের উন্নয়নে ও যে কোন সংকট মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। রাজনীতিতে ও নেতৃত্বে দক্ষ যুবশক্তি সম্পৃক্তকরণ নিশ্চিত করতে পারলে তা দেশের উন্নয়নকে আরো বেশি গতিশীল ও টেকসই করে তুলবে। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতেও যুবরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যুবশক্তিতে বিনিয়োগ দেশের উন্নয়নের জন্যই লাভজনক। পরিচ্ছন্, মেধাবী ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব তুলে আনতে কাজ করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, যুবদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সারা বিশ্বেই কম, বাংলাদেশে আরো কম। এর পেছনে রাজনৈতিক এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বয়সসীমাকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
যুবদের যুক্তির রাজনীতি নিশ্চিত করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদে, সংসদে যুবদের অংশগ্রহণ জরুরি এবং সেজন্য যুবদেরই উদ্যমী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি তারুণ্যের প্রগতিশীলতাকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, রাজনৈতিক চর্চায় সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত ও দুর্নীতির প্রবণতা দূর না করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। যুবদের মাদক থেকেও মুক্ত রাখার আহ্বান জানান তিনি। যুবদের দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, রাজনৈতিক চর্চায় সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত ও দুর্নীতির প্রবণতা দূর না করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। যুবদের মাদক থেকেও মুক্ত রাখার আহ্বান জানান তিনি। যুবদের দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টিও কেন্দ্রীয় সদস্য আব্দুল্লাহ আল কাফি রতন বলেন, তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি করে নেতৃত্বে প্রবেশের সুযোগ তরুণরা পাচ্ছে না। তাদের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশের ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। দলের নীতিগত পরিচালনার ক্ষেত্রে তরুণদের সরাসরি ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মূল্যবোধ এর দিক থেকে অবক্ষয় ঘটছে। তাই সবার আগে তরুণদের চিন্তা ও বিবেকের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে, সংস্কার আনতে হবে রাজনীতির মূল স্তরে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি বলেন, যুবদের সার্বিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রয়োজন সবার জন্য একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা গড়ে তোলার জন্য নীতিগত ব্যবস্থাগ্রহণ ও সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে। মূল সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলসমূহের কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একশনএইড বাংলাদেশ-এর পরিচালক আসগর আলী সাবরি বলেন, দেখার বিষয় হলো দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ যুবদের উন্নয়নে কাজ করছে নাকি যুবরা প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছে। প্রতিনিধিত্বশীলতার ধারা তৈরি করবে। রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা।
তিনি বলেন, গবেষণার মধ্য থেকে উঠে আসে যে পরিবার ও সমাজ থেকে ভীতি ও অনুৎসাহিত করার ফলে তরুণরা রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত হয় না। বড়দের থেকে ছোটদের দিকে দায়িত্ব হস্তান্তরের চর্চাও জরুরি। জ্যেষ্ঠদের অভিজ্ঞতার সাথে তারুণ্যের উদ্যমের সম্মিলনেই দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা দরকার।
রাজনৈতিক পরিসরে যুব প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির জন্য এবং যুব নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও করণীয় নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও শিক্ষা-গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা