All-focus
ড. ইকবাল হুসাইন : রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন নতুন নয়। দুর্নীতিবাজ, চোর এবং চাটার দল সম্পর্কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বিভিন্ন সময় ক্ষোভ এবং হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। যুব এবং ছাত্রনেতাদের হাতে অর্থ, অস্ত্র এবং মাদকের অবাধ সমাগম ঘটে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় থেকে। এরপর আর দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনীতির সবুজ ক্ষেতে জেঁকে বসেছে সম্রাট, পাপিয়াদের মত আগাছা ও নীতিহীন দুর্বৃত্ত! ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে নীতি ও আদর্শ নির্বাসিত হয়েছে।
জি.কে শামীম, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এনামুল হক আরমান, সফিকুল ইসলাম ফিরোজ, এনামুল ভূঁইয়া, রুপন ভূঁইয়া সবাই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পদ-পদবি ব্যবহার করে বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। এদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের তালিকায় সবশেষ সংযোজন শামীমা নূর পাপিয়া। তিনি নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক। যুবলীগের কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ। কম্পিউটার অপারেটর থেকে যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক। এরপর মাত্র বারো বছরে তিনিও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। পদবাণিজ্য, দুর্বৃত্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং অদৃশ্য উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপিসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এদের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যখন শুদ্ধি অভিযান শুরু হয় তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, নিজ দল কিংবা আত্মীয়-স্বজন কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু শ্লথ গতি এবং দীর্ঘ বিরতির কারণে শুদ্ধি অভিযানের কার্যকারিতা এবং সফলতা সম্পর্কে ইতোমধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।
শুদ্ধি অভিযানে ইতোমধ্যে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে দু’একজন ব্যতীত কেউই জাতীয়ভাবে পরিচিত মুখ নন। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের একজন স্থানীয় নেতা/নেত্রী কীভাবে এতটা বেপরোয়া, দাপুটে এবং অদৃশ্য আয়ে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন? প্রভাবশালী বড় কোনো নেতার আশীর্বাদ ছাড়া কারো পক্ষে ‘জিরো থেকে হিরো’ হওয়া সম্ভব নয়। নেতার আশীর্বাদপুষ্ট এবং স্নেহধন্য হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তাকে সমীহ করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমীহ পেলে আর কে আটকায়! স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও তখন কোণঠাসা হয়ে পড়েন। অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। দল এবং দলের বাইরে তিনিই হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। সমৃদ্ধির পথকে আরো মসৃণ করতে শুরু হয়ে যায় ‘ফুলের কারবার’। যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট! তুষ্ট দেবতার সিন্ডিকেটে রাজনৈতিক গডফাদার থেকে সরকারি কর্মকর্তা অনেকের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। শামীম, সম্রাট, এনামুল, রূপন, পাপিয়া, আনিস এই সিন্ডিকেটেরই প্রোডাক্ট।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শামীমা নূর পাপিয়া সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানতেন এবং তাঁর নির্দেশেই পাপিয়াকে ধরা করা হয়েছে। বিষয়টির ইতিবাচক দিক হলো কোনো কিছুই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায় না। কিন্তু একই সাথে এ প্রশ্নও চলে আসে যে, সবকিছু কেন কেবল প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হবে? জেলা পর্যায়ের একটি অঙ্গসংগঠনের নেত্রীর দীর্ঘদিনের অপকর্ম কেন বাকি সবার নজর এড়িয়ে গেল? পাপিয়া তো একদিনে তৈরি হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কীভাবে তাকে এতদূর আসতে দিলেন? আইন-শৃঙ্খলা এবং গোয়েন্দা বাহিনী বা এতদিন কেন ঘুমিয়ে ছিল? প্রধানমন্ত্রী বলার পর সবার ঘুম ভাঙলো?
আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল যার সাংগঠনিক শক্তি গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায়ই প্রত্যেক নেতার আমলনামা সংগ্রহ করা যায়। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ এটি করেও থাকে। তাহলে যেসব দুর্বৃত্ত দল এবং পদ-পদবি ভাঙিয়ে, প্রভাবশালী কোনো নেতার আশীর্বাদে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে কেন সাংগঠিনক ব্যবস্থা নেয় না? নীতিহীন, অসৎ ও ক্ষমতালোভী এসব হাইব্রিড নেতার কারণেই সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দিনের পর দিন কেউ অপকর্ম চালিয়ে যাবে আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছু জানবে না তা কি বিশ্বাসযোগ্য? বস্তুত এরশাদ শিকদার থেকে নূর হোসেন, সম্রাট থেকে পাপিয়া সবাই দুষ্ট রাজনীতিক এবং তুষ্ট কর্মকর্তাদের যৌথ প্রয়াসের ফসল।
কোনো ঘটনায় কেউ আলোচনায় এলে বা চিপায় পড়লে দুদক তার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে। বলা যেতে পারে, ‘মরা ঘোড়ার ময়নাতদন্ত’! কিন্তু কোনো তেজি ঘোড়ার গলায় লাগাম পরানোর ক্ষেত্রে দুদকের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অসৎ, অদৃশ্য এবং অপ্রদর্শিত আয় অনুসন্ধানে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করলে কারো পক্ষেই অনৈতিকভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বাড়ি, গাড়ি, ক্লাব, লাইফ স্টাইল, প্রভাব বিস্তার, ক্ষমতার দাপট নানাভাবে টাকার অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। অসৎ উপার্জনের জৌলুশ আরো অনেক বেশি! সুতরাং এদেরকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন নয়। কেবল রাজনীতিক নয়, আমলা, সরকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সব সেক্টরেই অসৎ উপার্জনে বিত্তশালীর ছড়াছড়ি রয়েছে। বাঁশ থেকে বালিশ কান্ড, পর্দা কিংবা কলম কাণ্ড তারই প্রমাণ।
দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনাকে যতদিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা না যাবে ততদিন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর্থিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু কারো দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়নি। শেয়ার বাজারকে অনেকে জুয়া খেলার সাথে তুলনা করেন। ক্যাসিনোকাণ্ডের মতো শেয়ার বাজার থেকেও শত শত কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। কিন্তু লুটেরাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করা যায়নি। একইভাবে ব্যাংক থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘ডাকাতি’ হয়ে গেছে।
বিচার কিংবা শাস্তি দূরে থাক, এসব ব্যাংক-ডাকাতদের বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে। একজন কৃষক ১০ হাজার কিংবা একজন সাধারণ পেশাজীবীকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অসংখ্য তথ্য, কাগজপত্র, সাক্ষী, গ্যারান্টার, যাচাই-বাছাই, সিআইবি (দি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) আরো কত কি প্রয়োজন হয়। একটু গরমিল হলেই ঋণ বন্ধ। অথচ হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, আইএলএসএফএলসহ বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। কিভাবে?
এদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া কেউই আইনের আওতায় আসেননি। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ। তিনিও আছেন বহাল তবিয়তে। কোনো রাষ্ট্র যতক্ষণ দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন নিশ্চিত করতে না পারবে ততক্ষণ সমাজে শামীম, সম্রাট, পাপিয়াদের উত্থাপন বন্ধ হবে না। মুজিববর্ষের রাষ্ট্রীয় শপথ হোক, কেবল রাজনীতির আগাছা নয়, সমাজকে সব জঞ্জাল ও আগাছা থেকে মুক্ত করবো।
# ড. ইকবাল হুসাইন, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা