অনলাইন ডেস্ক
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে পাহাড়ে প্রায় আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে চলা শান্তিবাহিনী নামক গেরিলা বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর প্রত্যাশাই ছিল চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। কাগজে কলমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নাম হলেও দেশ বিদেশের পর্যবেক্ষকরা এই চুক্তির নাম দিয়েছিল শান্তিচুক্তি।
চুক্তির ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশে প্রশংসা পাওয়ার পাশাপাশি নানা পুরস্কার ও উপাধী অর্জন করেন।
শান্তির আশায় চুক্তি করে সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন ও সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়ার আজ ২৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু সবুজ-শ্যামল ছায়া সুনিবিড় পার্বত্য চট্টগ্রামে আজও শান্তি অধরা। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় ইতিমধ্যেই পাহাড়ের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বারুদের গন্ধ। প্রতিনিয়তই স্থানীয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বলি হওয়া মানুষের রক্তের রক্তিম হচ্ছে পাহাড়ের পরিবেশ।
গত বুধবারও (৩০ নভেম্বর) রাঙামাটির সাজেকে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন জেএসএসের কর্মী সজীব চাকমা (২২)। গতবছরও ঠিক একই তারিখে রাঙামাটি সদর উপজেলায় আবিস্কার চাকমা নামের একজনকে হত্যা করেছিলো পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা।
সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন দায়িত্বশীল সরকারি একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৭৪ থেকে পাহাড়ে ব্যাপকহারে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে সে সময়কার শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিহত, আহত ও অপহরণ/নিখোঁজের শিকার হয়েছে অন্তত ৮১৪০ জন। তার মধ্যে পাহাড়ি ১১৩৮, বাঙালি ১৪৪৬ নিয়ে নিহত হয়েছে সর্বমোট ২৫৮৪ জন। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে (উপজাতীয়-৮২০, বাঙালি-১৭৯৮) ২৬১৮ এবং অপহরণের শিকার হয়েছে (উপজাতীয়-১৮০০,বাঙালি-১১৩৬ জন) সর্বমোট ২৯৩৬ জন।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের রক্ষাসহ অত্রাঞ্চলের ভূখণ্ড রক্ষায় দায়িত্বপালন করতে গিয়ে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় একাত্তর থেকে চলতি ২০২২ এর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বমোট ৩৮০ জন সদস্য শহীদ হয়েছে। তারমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭১, বিজিবি’র ১১১, পুলিশের ৩২ ও আনসার ব্যাটালিয়নের রয়েছে ৩৮০ জন। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে ৪৪৬ জন। আহতদের মধ্যে ২৪১ জন সেনা সদস্য, বিজিবি’র ১০২, পুলিশের ৯০, আনসার বিডিপির রয়েছে ১৬ জন।
পাহাড়ের মানুষের আত্মসামাজিক উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বমোট ৪৬০০ কিলোমিটার সড়ক পথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তির পূর্বে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ছিলো ১১৬০ কিমি, আর চুক্তির পরবর্তীতে চলতি ২০২২ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ৩৪৪০ কিলোমিটার সড়ক। এছাড়াও সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১০৩৬ কিলোমিটার সড়ক। আগামী ২০২৪ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পটি শেষ হবে বলে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন সূত্রে জানাগেছে।
এখন পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারি ৪৩টি হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল ১৬টি, সরকারি ৩৮৫টি ক্লিনিক, বেসরকারি ৫১ নিয়ে সর্বমোট ৪৯৫টি হাসপাতাল/ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিমধ্যেই তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ সর্বমোট ৭৩২৯টি শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করা হয়েছে। তারমধ্যে কল-কারখানা সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৩২টি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সরকারি ১১টি ও বেসরকারি ৭২৮৮টি রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বমোট ১২৮টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। এই গুচ্ছগ্রামগুলোতে বাঙালি ৪৪৯২৮ ও পাহাড়ি পরিবার রয়েছে ২৬৭৭টি। এতে করে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে। এই জনসংখ্যার মধ্যে কর্মহীন বেকার অবস্থায় রয়েছে ৯৪ হাজার ৬৩৪ জন বাঙালি ও ৬ হাজার ৮৪৯ জন উপজাতি। পার্বত্য চুক্তির পর হতে ২০২২ এর অধ্যবদি পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় নতুন করে ১৪৭টি কিন্ডারগার্ডেন, ৮১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০৪টি হাইস্কুল, কলেজ ২৫টি, মাদ্রাসা ১৩৩টি, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ১১টি, নার্সিং ইন্সটিটিউট ১টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি (সরকারি ১), একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।
পাহাড়ের মানুষের ধর্মপালনে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬৬০টি বৌদ্ধ কিয়াং, ৭১৪ টি গীর্জা, ৪৪৬টি মন্দির ও ১৪৩৪টি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে সামরিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এতকিছুর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে থেমে নেই হত্যার রাজনীতি। অত্রাঞ্চলে বিগত ২৫ বছরে ৯০১ জন পাহাড়ি,৩৯০ বাঙালিসহ সামরিক/আধাসামরিক বাহিনীর মোট ১৩০৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সর্বমোট ১৮২৩ জন। চুক্তির পরবর্তী সময়ে ২৫ বছরে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছে সর্বমোট ২১৯৮ জন।
এতোগুলো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি জাতিস্বত্তার কথা বলে নিজেদের স্বার্থের জন্য বিপুল অংকের অর্থের জন্য দেশদ্রোহী জঙ্গিগোষ্ঠিদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে পাহাড়ি উপজাতীয় আঞ্চলিকদলগুলো। এতে করে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন মোটেও সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন চুক্তি সম্পাদনকারী কমিটির অন্যতম সদস্য রাঙামাটির এমপি দীপংকর তালুকদার।
তিনি বলেন, চুক্তির পর থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এর সন্ত্রাসীদের হাতে ব্যাপকহারে মার খাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি চুক্তির বিরোধীতাকারী সংগঠন ও রাজনৈতিকগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে জোট করে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি, সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকাদের নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের রোডম্যাপ মোটেও সম্ভব নয়। তিনি সকলকে তাদের ভুল পথ পরিহার করে একই মঞ্চে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছে আওয়ামী লীগই এটার বাস্তবায়ন করবে কিন্তু আস্থার জায়গাটা সৃষ্টিতে সকলের এক হতে হবে। অন্যথায় কিছুই হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে হতাহতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্যোগজনক। চুক্তির ২৫ বছর পর আজও প্রশ্ন উঠছে আসলেই কি পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে? প্রশ্নটির উত্তরে যে কেউ বিনা বাক্যে বলতে বাধ্য যে, শান্তিতো আসেইনি বরং খুন-চাঁদাবাজির ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সে সময়ে জনসংহতি সমিতি নামে একটি মাত্র আঞ্চলিক সংগঠন ছিল; যাদের সশস্ত্র শাখা ছিল শান্তি বাহিনী। আর চুক্তির পর এই সংগঠন থেকেই জন্ম হয়েছে ইউপিডিএফ থেকে শুরু করে গুন্ডুস বাহিনীসহ আরও ছয়টি সশস্ত্র সংগঠনের। যাদের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে পাহাড়ের পরিবেশ।
এদিকে চুক্তির কারণে পাহাড় থেকে সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়ার কারণে দিনে দিনে পাহাড়-সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে উঠেছে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা