যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘‘ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ- আসুন এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলন আরও জোরদার করার লক্ষ্যে জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। মতবিনিময় সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। সভার উদ্দেশ্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বিশেষ কার্যক্রম উপস্থাপন করেন সংগঠনের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড.দীপ্তি সিকদার।
মতবিনিময় সভায় জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও ইন্দো-প্যাসিফিক এ্যাসোসিয়েশন অব’ল, মেডিসিন এন্ড সায়েন্সেস এর কংগ্রেস চেয়ারম্যান এবং সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো: মোজাহেরুল হক, বিশিষ্ট আইনজীবি ও গবেষক অ্যাড. জেয়াদ-আল-মালুম, বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক সমকালের যুগ্ম সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার ও ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক (অবঃ) ডা. শাহিদা চৌধুরী, দলিত নেতা রামানন্দ দাস ও বনানী বিশ্বাস, প্রকৌশলী আসাদ দৌল্লাহ আল-সায়েমসহ ৩২জন উপস্থিত ছিলেন।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে বিগত বছরে যখন নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন সকলকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলে।এই কমিটি জেলা শাখা, তৃণমূল পর্যায়েও গঠন করা হয়েছে, যা নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে গেলেও সামাজিক সূচকে নারীরা পিছিয়ে আছে সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করে প্রকৃত মানব উন্নয়নের জন্য সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সংগঠনের সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তবে কেবল সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সহিংসতা, নির্যাতন প্রতিরোধ করা যাবে না। কিন্তু সহিংসতার ঘটনার বিচারে আইনী জটিলতার কারণে এখনো বাধা রয়েছে। নির্যাতন প্রতিরোধে সকল কে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রশাসন, রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও ইন্দো-প্যাসিফিক এ্যাসোসিয়েশন অব’ল, মেডিসিন এন্ড সায়েন্সেস এর কংগ্রেস চেয়ারম্যান এবং সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো: মোজাহেরুল হক বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত নারী নির্যাতনের ঘটনার হার বৃদ্ধি আশংকাজনক। এটি প্রতিরোধ করতে প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে কোন লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটি দেখতে হবে। পাশাপাশি প্রতিরোধের লক্ষ্য অর্জনে কৌশলগত দিক ঠিক করতে হবে। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস দূর করতে হবে।
দৈনিক সমকালের যুগ্ম সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, মিডিয়াতে নারীর প্রতি সহিংসতার যেসকল ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে তা উদ্বেগজনক। প্রকাশিত সকল ঘটনার তথ্য সঠিক ও নয়। পারিবারিক ফতোয়া বা সামাজিক ফতোয়ার ঘটনা মিডিয়াতে আসে না। জেলা পর্যায়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্র ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অনলাইন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নারী নির্যাতনের ইস্যূকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যূ হিসেবে দেখে না। মিটিং, সমাবেশ ও সাংগঠনিক আলোচনা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে এবং মিডিয়ায় প্রকাশের আহবান জানান তিনি।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে। যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির কাজ মনিটর করতে হবে। প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন নাহার বলেন, সহিংসতার নানা ধরণ রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্যমতে ৮০ ভাগ নারী (সকল শ্রেণীর) বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনগ্রসর গোষ্ঠীর নারীরা নির্যাতনের শিকার হলে প্রকাশ করতে পারলেও উচ্চ শ্রেণীর নারীরা পারেনা। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সামাজিক আন্দোলনকে যুক্ত করতে হবে। মনস্তাত্তিক দিক পরিবর্তন করতে হবে। ধর্ষণের শিকার নারী কন্যাদের স্বাভাবিকভাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হবে। গৃহকর্মে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। অগ্রসর নারীদের ১% পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করতে চায় না সামাজিক ভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে। কিন্তু নির্যাতনকারীর অবশ্যই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে নির্যাতনকে মুখ বুজে সহ্য করে নেয়ার মানসিকতা দূর করতে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক প্লেসে যেকোনো নির্যাতনের ঘটনায় ১০৯ নম্বরে ফোন করার করা উল্লেখ থাকতে হবে।
ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে নেতৃত্ব প্রদানে, সচেতনতা তৈরিতে তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে। সকলকে সম্মিলিতভাবে নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।
দলিত নেতা রামানন্দ দাস বলেন, বাল্যবিবাহের ঘটনা এখনো ঘটছে। অনগ্রসর গোষ্ঠী এসব ঘটনা দেখলে ও প্রতিহত করতে পারছে না। তাদের সচেতন করা যেতে পারে।
উপস্থিত নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ তাদের বক্তব্যে সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলন আরো জোরদার করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ একটি সামাজিক আন্দোলন। এটি কোন মানবাধিকার সংগঠনের একক কর্মসূচী নয়। পাশাপাশি মূল্যবোধ ও দরকার নারী নির্যাতন বিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। আরও কিভাবে কাজ করলে এ্টা বন্ধ হবে সেজন্য এই মতবিনিময় সভার বক্তাদের সুপারিশ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। নারী ও কন্যা নির্যাতন ও সামাজিক অনাচার বন্ধ হতেই হবে।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম, প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা,আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ও ঢাকা মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দ, সংগঠনের কর্মকর্তা, আইনজীবী, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকসহ মোট উপস্থিত ৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আখতার।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা