অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক চাপের মধ্যে আছে। এ চাপ মূলত সৃষ্টি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এ প্রভাব থেকে অন্যান্য দেশ কাটিয়ে উঠলেও বাংলাদেশ এখনো পারেনি। এর কারণ, সরকারের গৃহীত কিছু ভুল নীতি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে এখন বহুমুখী সমস্যা চলমান। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে—উচ্চ মূল্যফীতি, ডলার-সংকট, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ক্ষয়, আর্থিক হিসাবে ঘাটতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি, উচ্চ আয়বৈষম্য, বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়া, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব ইত্যাদি। এখন নতুন সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জাতিসংঘ বলেছে, বিদায়ি ২০২৩ সালে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশি বেড়েছে। খাদ্যের বাড়তি দাম উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে।২০২২ সালের আগস্ট মাসে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বাড়িয়ে দেয়। এরপর ব্যাংক খাতে বহুল আলোচিত ৬ শতাংশ (ডিপোজিটরদের জন্য) এবং ৯ শতাংশ ( ঋণগ্রহীতার জন্য) সুদের হার প্রবর্তন করে। ফলে ঋণ সস্তা হয়ে পড়ে। বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। যার ফলাফল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা বর্তমানে দৃশ্যমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের শুরুতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেন। এ সিদ্ধান্ত অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে, বাংলাদেশ তখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদহার (রেপো) বাড়িয়ে বাজারে অর্থের জোগান কমানো হয়। অর্থাত্ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। দুঃখজনক যে, নীতি সুদহার বাড়ানো সত্ত্বেও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি (যেটা জুন-ডিসেম্বর ২০২৩-এর জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল) ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। বিবিএসের তথ্য মোতাবেক, ২০২৩-এর ডিসেম্বরের শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।এ মাসের ১৭ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য জানুয়ারি-জুন ২০২৪ সময়ের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো—(১) মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ; (২) ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোগান বাড়ানো; (৩) খেলাপি ঋণ কমানো ও (৪) ডলার-সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানো। এছাড়াও বিনিময় হার স্থিতিশীলতা রাখার জন্য এবারের মুদ্রানীতিতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ঘোষণা করেছে। এটা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। এবারের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার (রেপো) বাড়িয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। আগে ছিল ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিশেষ রেপো বা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপো বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার বিদ্যমান ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার নির্ধারণ করা হয় রেপো বা নীতি সুদহারের মাধ্যমে। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখে। এ বছরের জুন পর্যন্ত জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি এবং সরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে—১০ শতাংশ এবং ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্রড মানির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। নিট বৈদেশিক সম্পদের ক্ষয় ২ দশমিক ৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এবারের মুদ্রানীতির ধরন হলো, ‘সতর্ক ও সংকুলানমুখী।’ প্রশ্ন হলো পূর্বে নীতি সুদহার বাড়ানো সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। কেন? আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো—(১) অভ্যন্তরীণ জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া; (২) দুর্বল মুদ্রানীতি; (৩) টাকার অবমূল্যায়ন ও (৪) বৈদেশিক মুদ্রা কমে যাওয়া। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি এবং বাজারনীতিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অর্থাত্ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশনকে একই সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ, উচ্চ আমদানি কর বা ট্যারিফ রেট। যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশে গড় ট্যারিফ রেট ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে বিশ্বে গড় ট্যারিফ রেট মাত্র ৬ শতাংশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে গড়ে ট্যারিফ রেট ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। মূলত সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং অভ্যন্তরীণ শিল্পগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ট্যারিফ রেট বাড়ানো হয়। ২০২২ সালের মে মাস থেকে ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। টিসিবির তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারি মাসের ৮ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত ১৩টি পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার ডলার-সংকটের কারণে আমদানি অত্যধিক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর। দুঃখজনক যে, ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম গড়ে ১০ শতাংশ কমেছে, বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য কমেছে ১৪ শতাংশ, পণ্য পরিবহন ব্যয় কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েনি। আমার মতে, আমদানি কর কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়াতে পারলে একদিকে মূল্যস্ফীতি কমবে, অন্যদিকে সরকারের করের ভিত্তি মজবুত হবে। অটোমেশন পদ্ধতি চালু করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। এবারের মুদ্রানীতি নিয়ে কিছু সমালোচনা করে সুপারিশ করতে চাই। এ কলামের প্রথমে বলেছি, শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। রাজস্বনীতিকে সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখন তারল্যসংকটে আছে। ব্যাংকের তারল্য সুবিধা প্রদানের জন্য বিশেষ রেপোর হার কমানো হয়েছে। অন্যদিকে রেপো রেট (নীতি সুদহার) বাড়ানো হয়েছে। একদিকে সংকোচনমূলক, অন্যদিকে সম্প্রসারণমূলক সিদ্ধান্ত। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা সত্য যে, ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটে পড়ে গেছে। টাকা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তারল্যসংকটের পেছনে শুধু কি ডলার সংকট দায়ী? অধিকাংশ ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। কৃত্রিমভাবে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করা হবে বাংলাদেশের প্রধান কাজ। বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য মুদ্রানীতিতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি অনুসরণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা প্রয়োজন যে, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে। ১৯৯০ সালে ৬৮ শতাংশ উন্নত এবং দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। ২০০১ সালে এটা কমে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপর তারা ফ্লোটিং রেট গ্রহণ করে। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য নীতি সুদহার ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা দরকার ছিল। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অর্থনীতিতে অন্যান্য অভিঘাত মেনে নিতে হবে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ এখন অন্যতম উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন সরকারের কাছে চাওয়া থাকবে অতিদ্রুত মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিম্ন এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের বাঁচিয়ে রাখুন।fblsk
আরোও পড়তে পারেন : আন্দোলনরত চাকরিচ্যুত কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় বিচার দাবি