শেখ মোঃ শিমুল, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিঃ কবির ভাষায় “নয় চামেলি , নয় সে বকুল, নয় তো কানের দুল? সে আমাদের ফলের রাজা, আমের-ই মুকুল”। আমগাছের মুকুলে মুখর হয়ে উঠেছে মুন্সীগঞ্জ জেলার চারিদিক। জেলার নানা জায়গায় আমগাছের মুকুলে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য ফুঁটে উঠেছে। এ যেন আম গাছটি বছর পরে যৌবনের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেল।
ছোট বড় সকলের চোখ কেড়ে নেয় মুকুলে। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে প্রকৃতির বাতাস হয়ে উঠেছে সুরভিত। এখন যেন অপেক্ষার পালা মুকুল থেকে আমে। তবে অনেক গাছে মুকুল থেকে ছোট-ছোট আমের আকারও ধারণ করেছে। কাঁচা বা পাঁকা আম দুটিই রসে টইটুম্বুর। বাঙ্গালির কার না ভাল লাগে আম খেতে। বৈশাখ-জষ্ঠি মাসে আম নিয়ে না কতো আয়োজন। আমের বাহারি রেসিপি। আম-ডাল, আমের আচার, আমসত্ত্ব , আমের অম্বল, আম জুস সহ কতইনা পথ্য আয়োজন করে থাকে আমাদের পরিবারে।
কবির ভাষায় “বাংলাদেশের ফলের ভেতর আমটি দারুন মজা, এ ফল নিয়ে গর্ব করে, রাজা কিংবা প্রজা। দুধের সাথে আম মিশিয়ে খেতে ভাল লাগে, কাসুন্দি আর আচার খেতে কাহার না সাধ জাগে?
মুন্সীগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ না হলেও জেলার সদর, গজারিয়া, টঙ্গিবাড়ী, সিরাজদিখান, শ্রীনগর ও লৌহজং সহ সকল উপজেলার অধিকাংশ বাড়িতে, রাস্তার পাশে, অকৃষি পতিত জমিতে, পুকুরপাড়ে, কৃষি জমির সীমানা-আইলসহ বিভিন্ন জমিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে আম গাছ। অনেকে নিজস্ব জমিতে শখের বসত তৈরী করেছে আমের বাগান। জেলার বিভিন্ন স্থানে তাকালে আম গাছে মুকুলে চোখে পড়ার মতো। আমের দিনে আত্মীয়ের বাড়িতে আম নিয়ে যাওয়া, প্রিয় জনদের আম উপহার দেওয়া, বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে জামাইষষ্ঠী। এসব যেন এখন মনে করিয়ে দিচ্ছে। মুকুল দেখে ছোট-বড় সকলের মুখে দিয়েছে মিষ্টি হাসি। আমের মুকুল দেখেই আনন্দ বিরাজ করছে জেলার সববয়সীদের মধ্যে।
মুন্সীগঞ্জ জেলার আম এর আকার ও রঙ দেখায় খুবই সুন্দর, খাওয়ায়ও সুস্বাদু। জেলায় হিমসাগর, লেংড়া, ফজলী, চোষাসহ কয়েক ধরনের আম হয়ে থাকে। তবে এ যেন বাধ সেজেছে বিভিন্ন ফ্যাক্টরীর ডাস্ট ও ধোঁয়া।
মুন্সীগঞ্জের নদী তীরবর্তীসহ অনেক স্থানে গড়ে উঠা অসংখ্য সিমেন্ট ফেক্টরী হতে নির্গত ডাস্ট, ইট ভাটা ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়ায় আম গাছসহ বিভিন্ন ফলের গাছের ব্যাপক ক্ষতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অধিকাংশ আম গাছে পর্যাপ্ত পরিমাণের মুকুল আসলেও তা আমে রুপ নেয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের বাতাসে ক্রমান্বয়ে এসকল কলকারখানার দূষণের প্রভাবে অনেক গাছ মরে যাচ্ছে। অনেক প্রজাতি তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হারিয়ে যাচ্ছে। ফলের আকৃতি ও রঙ পরিবর্তিত হওয়া সহ গাছে নানা রোগও দেখা দিচ্ছে বলে অনেকের অভিমত।
নার্সারির কাজে নিয়োজিত সাইফুল ইসলাম জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলায় দেশীয় আম গাছের চাড়ার চাহিদা অনেক বেশি এর মধ্য রয়েছে হিমসাগর, লেংড়া, ফজলী, চোষা, স্বর্ণরেখা, আমরুপালী সহ আরো অনেক।
তিনি আরো জানান, জেলায় অনেকগুলি সিমেন্ট ফেক্টরী ডাস্ট, ইটভাটা, কলকারখানার কালো ধোঁয়ায় গাছের পাতা নষ্ট হয়ে যায়, গাছ তাড়াতাড়ি মরে যায়। গাছে ফলও কম হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোঃ শফিকুল হাসান জানান, আম গাছে আমের মুকল এসেছে। জেলায় আমের বড় বড় বাগান না থাকলেও বাড়ির আঙ্গীনায় ও জমিতে প্রচুর আমগাছ রয়েছে। এ জেলায় লেংড়া, আমরুপালীসহ নানা ধরনের আম হয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, গবেষকদের মতে সিমেন্ট ফেক্টরী ডাস্ট, ইটভাটা সহ বিভিন্ন কালকারখানার ধোঁয়া আমের মুকুলসহ গাছের অনেক ক্ষতি করে। সিমেন্টের ডাস্ট ও ধোঁয়া মুকুলে পড়ে পরাগায়ন নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অনেক মুকুল নষ্ট হয়। গাছের পাতা থেকে গাছ খাদ্য তৈরি করে। সিমেন্ট ফেক্টরীর নির্গত ডাস্ট পাতায় পড়ে এর মধ্যে ভোরের শিশির পড়ে পাতার উপর জমাট বেঁধে যায়। ফলে গাছ তার খাদ্য তৈরি করতে না পেরে অনেক গাছ মারা যায়। কৃষি ফসলেরও ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, আমের মুকুল রক্ষার্থে প্রতিদিন সকালে আমগাছে পানি স্প্রে করে গাছগুলি পরিস্কার করতে হবে। যদিও এটি সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ এগুলি করতে হলে কৃষকের আলাদা লোক নিয়োগ দিতে হয় এবং লোকদের পিছনে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ পানি স্প্রে করলে মুকুলে ও গাছের পাতায় জমে থাকা ডাস্ট ধুয়ে পরিস্কার হয়ে গেলে আম ও গাছ অনেকটাই রক্ষা করা সম্ভব।
মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ রাসেল কবির জানান, বায়ুতে ভাসমান কনার আকারে- বায়ুস্থ কণা আকার(মাইক্রন) বায়ুমণ্ডলীয় ডাস্ট-(০.০০১-৪০), ভাইরাস-(০.০০৫-০.৩), তামাক ধূমপান-(০.০১-৪), ব্যাকটিরিয়া(০.৩-৬০), কাঠ পোড়ানো-(০.২-৩), কার্বন ডাই অক্সাইড-(০.০০০৬৫), অটো গাড়ি কালোধোঁয়া-(১-১৫০), ফ্লাই এ্যাশ-(১-১০০০), সিমেন্ট ডাস্ট-(৩-১০০), বালু-মিহিকণা-(০.০০৫ ইঞ্চি)১২৫(মাইক্রন), বালি- মাঝারি-(০.০১ ইঞ্চি)২৫০(মাইক্রন), বালু-মোটা-(০.০২ ইঞ্চি)- ৫০০(মাইক্রন)। বায়ু মন্ডলে এই পার্টিক্যাল অনুযায়ী থাকে।
এই প্রক্রিয়ায় ধুম (fume)+জলীয়বাষ্প+ধূলা (dust) সমন্বয়ে সৃষ্টি ধোঁয়াশা। এ ধোঁয়াশা উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ, শ্বসন, প্রস্বেদনকে প্রভাবিত করতে পারে এবং বায়বীয় বিষাক্ত পদার্থ উদ্ভিদে প্রবেশে সাহায্য করতে পারে। যদি ধূলিকণা পত্ররন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে তবে তাতে উদ্ভিদে কিছুটা যান্ত্রিক আঘাতের লক্ষণ প্রকাশ পায় আর এর সাথে যদি কিছু দ্রবণীয় বিষাক্ত পদার্থ থাকে তাহলে উদ্ভিদের সাধারণ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। এছাড়াও ধোঁয়াশা উদ্ভিদের পত্ররন্ধ্র বন্ধ-খোলার রুটিন ও নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর প্রতিবন্ধকতা, কার্বন-ডাই অক্সাইড বিনিময় হার হ্রাস এবং কার্বন সংশ্লেষ হ্রাসের ফলস্বরূপ উদ্ভিদের নেট সালোকসংশ্লেষণের হ্রাসমূলক হার পরিলক্ষিত হয়। এতে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও ফলন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আবার পাতার পৃষ্ঠের ধূলিকণা রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা উদ্ভিদ টিস্যুতে সরাসরি আঘাতের কারণে উদ্ভিদ-বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হতে পারে। এই জাতীয় প্রভাবের জন্য ধুলির সঠিক পরিমাণ জানা যায়নি তবে এটি নূন্যতম ১.০ গ্রাম / এম 2 / দিন বা বাতাসের একিউআই মাত্রা ০-৫০ পিপিএম।
তিনি আরো জানান, মুন্সীগঞ্জে এই নূন্যতম মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি থাকায় এখানকার বেশিরভাগ উদ্ভিদ সম্প্রদায় ধূলিকণার জঞ্জাল দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয় ফলে ঐ প্রজাতির স্বকীয়তাও নষ্ট হতে পারে।
মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নয়ন মিয়া পরিবেশের ও মানবদেহের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে জানান, মুন্সীগঞ্জ জেলার ক্যাম্প স্ট্যাশন না থাকায় বাতাসের ধূলি-কনা পারিমাপ করা সম্ভব নয়। এর জন্য ক্যাম্প স্ট্যাশন স্থাপন করা জরুরী। এছাড়া, হাই ভলিউম স্যাম্পলারের মাধ্যমে ইনড্রাস্ট্রিজের এসপিএম(সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার)এর সীমা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রো গ্রাম। তবে সিমেন্ট ফ্যাক্টরির অঞ্চলে এসপিএম প্রতি ঘনমিটারে ৩০০ মাইক্রো গ্রাম। কখনও কখনও অধিক বেড়ে গিয়ে এসপিএম প্রতি ঘনমিটারে ৫০০ মাইক্রো গ্রামে চলে যায়।
তিনি জানান, এসকল সিমেন্ট ফেক্টরীগুলো আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করছে না। এর জন্য প্রয়োজন ইকোহেগার, সেন্টিফিউগার টাওয়ার, ডাস্ট কালেক্টর বেগফিল্টার ও গ্রেভিটেশনাল চেম্বার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এসকল আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে কোনমতেই ডাস্ট বাহিরে যাবো না। তারা সীমিত আকারে ডাস্ট কালেক্টর বেগফিল্টার ব্যবহার করলেও তা প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট নয়। এব্যপারে আমরা বার বার বলে আসছি।
তিনি আরো জানান, তাদেরকে আমরা এনফোর্সমেন্টের আয়োতায় এনে আর্থিক জরিমানা করছি। এর পরেও তারা কোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা