মাহফুজ সিদ্দিকী – সৎ মানুষের নীরব প্রস্থান
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি সবেমাত্র। অংকের ছাত্র। বরাবরই হিসাবী। ইংরেজী বিষয়েও ভালো ছিলাম। মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়ই লেখালেখির অভ্যাস। মফঃস্বল শহরে একটু আধটু সাংবাদিকতাও করি। ছাপার অক্ষরে নিজের নামটা দেখলে বেশ ভালোই লাগতো! ছড়া, কবিতা, গল্প এবং সংবাদে বেশির ভাগ নামেই প্রকাশ হতো। কী যে পরমানন্দ!
১৯৮৭ সাল। হিসাববিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেয়ার পর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। হলের পাঠাগারে অনান্য দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাপ্তাহিক বিচিত্রা, রোববার, চিত্রালী ও পূর্বাণী রাখা হতো। ঢাকায় পড়াশুনার পাশাপাশি প্রদায়ক বা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতাও করি। কিন্তু স্থায়ী হবার বাসনা পেয়ে বসে একসময়! ছুটির দিনে সকালে একদিন পাঠকক্ষে গিয়ে সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালী পত্রিকায় একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতে পাই। ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদে ভালো স্নাতক পাশ একজন সহ সম্পাদক প্রয়োজন। আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় হাতে আছে মাত্র ৬ দিন। জীবন বৃত্তান্ত হাতে লিখলাম। স্নাতক পাশের সত্যায়িত সাময়িক সনদ ও ছবি নিয়ে বায়োডাটা তৈরি! হল থেকে বের হয়ে মেডিকেল থেকে ৩ নম্বর বিআরটিসি বাসে করে সোজা জিপিও। ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিতরণ প্রক্রিয়ায় রেজিষ্ট্রি ডাকে মতিঝিল অবজারভার ভবনে আবেদন পত্র পাঠালাম। এবার অপেক্ষার পালা। মনে মনে ভাবলাম সাংবাদিকতার চাকরি আমার হয়ে যাচ্ছে! চিত্রালীতে চাকরির সুবাদে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের নায়ক ও নায়িকাদের কাছে যেতে পারবো! ঠিক ১১ দিন পর হলের ঠিকানায় চাকরি সাক্ষাৎকারের চিঠি এলো।
আনন্দের আতিশয্যে বিষয়টি নিয়ে টিএসসিতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র) সহপাঠীদের অনেকেই দুপুরের আহার হিসেবে ৫ টাকা মূল্যের বিরিয়ানি খাইয়েছি। চিত্রালীর সম্পাদক তখন গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার আহমেদ জামান চৌধুরী (আজাচৌ)। সাক্ষাৎকার পর্বে প্রথমে পেলাম সৌম্য ও রাশভারী মানুষ সহকারী সম্পাদক মাহফুজ সিদ্দিকী ভাইকে। তিনি জানালেন, ২৭টি আবেদনের মধ্যে ২ জনকে সাক্ষাৎকার পর্বে ডাকা হয়েছে। আমি এবং অপর প্রার্থী গুলশান আখতার। আগে গুলশানের পরীক্ষা নেয়া হয়ে গেছে। সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার হীরেন দে এবং নাট্যকার নরেশ ভূঁইয়া মিলে নাকি তার পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এটা জানতে পারি পরে আহাদ খান ভাইয়ের কাছে। আমাকে খোকা ভাই ফিল্মফেয়ার পত্রিকার একটি আইটেম অনুবাদ করতে দিলেন। খোকা ভাইয়ের কক্ষ থেকে বের হয়ে মাহফুজ ভাইয়ের টেবিলের সামনে বসে ৩৩ মিনিটে লেখাটির অনুবাদ শেষ করলাম। মাহফুজ ভাই তা দেখে বললেন চলবে আপনাকে দিয়ে। আমাকে নিয়ে চিত্রালী সম্পাদকের কক্ষে ঢুকলেন তিনি। সম্পাদক মহোদয়কে বললেন, অনুবাদে বেশ ভালো। হাতের লেখাও চমৎকার ওর। সেদিন ছিলো মঙ্গলবার। দৈনিক সংবাদ এর খেলাঘর পাতায় আমার একটি ছড়া ছাপা হয়েছে। সেটাও খোকা ভাইকে জানালেন তিনি। সম্পাদক বললেন- আমরা পরে যোগাযোগ করবো। ওনার রুমে বসা ছিলেন আলোকচিত্রী বেলাল এবং ফারুক ফয়সল ভাই। সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে এলাম সেদিন।
খবর জানার জানার জন্য ১১ দিন পর চিত্রালী কার্যালয়ে গিয়ে দেখি গুলশান আখতার একটা টেবিলে বসে কি যেন লিখছেন। পাশে বসে আছেন সংশোধক রোকেয়া কামাল। ওইদিন মাহফুজ ভাই ছিলেন না।
আরামবাগে টিউশনি করি। হলে ফেরার পথে ক’দিন পর সন্ধ্যায় দেখা মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে। হাত ধরে তিনি আমাকে দানেশ প্রেসে নিয়ে গেলেন। জানালেন সেটা তিনিই চালান। চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে জানলাম চিত্রালীতে চাকরি না হওয়ার নেপথ্য কাহিনী! বললেন, খোকা ভাই চাইলেই আমার সেখানে চাকরি হতো! আঙ্গুলের অগ্রভাগে চুন নিয়ে মুখে তা গুজে দিতে দিতে বললেন, আপনার মতো ভাল হাত সাংবাদিকতায় প্রয়োজন! ভালো লাগতো যদি আপনাকে সহকর্মী হিসেবে পেতাম!
পরে ১৯৯৮ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ অর্থনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ডেস্কে পেয়েছি নিভৃতচারী সৎ সাংবাদিক মাহফুজ সিদ্দিকী ভাইকে। টেলিপ্রিন্টার মেশিনে আসা ইউএনবি এবং বাসসের স্লেগে আমার অনুবাদ প্রতিবেদনগুলোয় তিনিই সহাস্যে শিরোনাম করে দিতেন। পালা প্রধান ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ(প্রয়াত) ভাই বা প্রণব সাহা(প্রয়াত) তাতে কলামের বিভাজন করে পাঠাতেন মধুমতি মুদ্রণালয়ে। এখানেও মাহফুজ ভাইয়ের উচ্চকিত প্রশংসা পেয়েছি।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল ছিলেন মাহফুজ সিদ্দিকী। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য, দৈনিক ডেসটিনির সাবেক সিনিয়র সহকারি সম্পাদক ছিলেন।
দৈনিক পূর্বদেশ এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন তিনি। সাপ্তাহিক চিত্রালী, বাংলার বাণী, দৈনিক জনকণ্ঠ, খবরপত্রসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নদী আমার কীর্তনখোলা, প্রেম তুই সর্বনাশী, চাবিটা দাও, পতিতা প্রিয়তমা, অনিদ্র ভ্রমরসহ অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতা।
যারা সত্যিকারের সৎ মানুষ, পরিশ্রমে নিবেদিত প্রাণ এবং অন্তর্মূখি তাঁরা নীরবেই হারিয়ে যান। যেমনটা চলে গেলেন দক্ষ অনুবাদক, সাহিত্যিক এবং প্রথিতযশা সাংবাদিক মাহফুজ ভাই।
(জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য প্রবীন সাংবাদিক মাহফুজ সিদ্দিকী সোমবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকার বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মাহফুজ ভাই’র মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছে সাংবাদিক সমাজ।)
# প্রণব মজুমদার লেখক সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, reporterpranab@gmail.com
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা