মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্রিয় প্রচেষ্ঠার মাধ্যমেই গ্রামীন জনগোষ্ঠীর উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহনে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একটি নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আশাপ্রদ সফলতা পাওয়া গেছে এমনটাই বলছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় পরিচালিত একটি গবেষণা।
গবেষণায় দেখা যায় উচ্চরক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত রক্তচাপ পর্যবেক্ষণ, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং নিয়মিত ঔষধ গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা কার্যকরভাবে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গবেষণালব্দ এই জ্ঞান হৃদরোগ ও মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত অসুস্থতা এবং মৃত্যু প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) আইসিডিডিআর,বি থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এতথ্য জানা গেছে।
এই গবেষণা পদ্ধতিটি বাংলাদেশে প্রচলিত সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর প্রয়োগ করা হয়েছে এবং এর প্রমানিত কার্যকারিতা উচ্চরক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা সেবা প্রদানে একটি সম্ভাব্য পথ তৈরি করেছে। গবেষণার প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে প্রচলিত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই পদ্ধতিটি সম্প্রসারনের জন্য সরকারকে বছরে জনপ্রতি মাত্র ০.৬০ ডলার বা ৫১ টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কোবরা-বিপিএস (নামক এই গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে বাংলাদেশের আইসিডিডিআর,বি, পাকিস্তানের আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় এবং শ্রীলংঙ্কার কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ডিউক-ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এর তত্বাবধানে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এই বহুদেশীয় গবেষণার ফলাফল বিখ্যাত মেডিকেল সাময়িকী ”নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন” এ বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তিন দেশের ৩০টি গ্রামীন এলাকায় ২৫৫০ জন উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর ২ বছর ধরে এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে টাঙ্গাইল ও মুন্সিগঞ্জ জেলার ১০ টি উপজেলায় ৮৯৫ জন উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর আইসিডিডিআর,বি এই গবেষণাটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর বিভাগের সহযোগিতায় পরিচালনা করে। এর মধ্যে ৫টি ্উপজেলার ৪৪৭ জন ব্যক্তিকে ’ইন্টারভেনশন’ দলে সংযুক্ত করা হয়। প্রতি ৩ মাস পরপর ১ জন সরকারী স্বাস্থ্যকর্মী রোগীর বাড়ীতে গিয়ে একটি ডিজিটাল রক্তচাপ পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে রক্তচাপ পরিমাপ করা সহ রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জীবনযাত্রা পরিবর্তনে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করেন। যে সকল ব্যক্তিদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল তাদেরকে নির্ধারিত উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠানো হয় যেখানে ডাক্তার উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসা গাইডলাইনের মাধ্যমে রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করে এবং এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহের ব্যবস্থা করে।
কোবরা-বিপিএস বাংলাদেশের প্রধান গবেষক ও আইসিডিডিআর,বি’র বিজ্ঞানী ও অসংক্রামক রোগ কর্মসূচীর প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ বলেন, গবেষণা শুরুর ১ বছরের মধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে কোবরা ইন্টারভেনশনে অন্তর্ভূক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে সিষ্টোলিক রক্তচাপ কমপক্ষে ৫ মিমি কমে গেছে এবং এই কমার হার দুই বছর পরও কার্যকর ছিল যা অত্যন্ত সন্তোষজনক। গবেষণা শেষে লক্ষ্য করা গেছে যে, ইনটারভেনশনে অর্ন্তভূক্ত র্গোীদের মথ্যে হৃদরোগ ও মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত (স্ট্রোক) রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ইন্টারভেনশনের বাইরে থাকা উচ্চরক্তচাপের রোগীদের তুলনায় অনেক কম ছিল। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী যে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগ বা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত অপরিণত বয়সে মৃত্যু প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কোবরা ইন্টারভেনশন পদ্ধতি বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
অধ্যাপক ডা. এ. এইচ. এম এনায়েত হোসেন, মহাপরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কোবরা বাংলাদেশ পরামর্শক কমিটির সভাপতি বলেন, কোবরা গবেষণার কৌশল ব্যবহার করে আমরা গ্রামীন এলাকায় উচ্চরক্তচাপের রোগীদের বিশেষতঃ মহিলাদের চিহ্নিত করে মানসম্মত চিকিৎসা গ্রহনে সহযোগিতা করতে পেরেছি। কোবরা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে ইতিমধ্যেই অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে।
গবেষণার প্রধান গবেষক ডিউক-ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, হেলথ সার্ভিস ও সিষ্টেম রিসার্চের অধ্যাপক তাজিন এইচ জাফর বলেন, দক্ষিণ এশিয়া, চীন, মেক্সিকো এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাড়ী বাড়ী গিয়ে মা ও শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের গবেষণা প্রমান করেছে যে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এই মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরাই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ও এই গবেষণার বাংলাদেশে সহ প্রধান গবেষক ড. জন ডেভিড ক্লেমেন্স বলেন, কোবরা-ইন্টারভেনশনের কৌশলগুলো স্বল্প খরচে প্রয়োগযোগ্য এবং টেকসই কার্যকর পদ্ধতি। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ধরনের একটি অভিনব পদ্ধতির প্রয়োগ দক্ষিন এশীয়ায় এই প্রথম যা এই অঞ্চলে পারস্পরিক সহযোগিতায় স্বাস্থ্য গবেষণার একটি চমৎকার উদাহরন। বাংলাদেশ, পকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও জনসংখ্যাগত ভিন্নতা রয়েছে তথাপি উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই দেশগুলির অবস্থা খুবই দূর্বল। এরকম ভিন্নতা থাকা সত্বেও সবগুলো দেশে এই গবেষণা থেকে প্রায় একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমানিত হয় যে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কোবরা পদ্ধতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি উপযুক্ত সমাধান। এ প্রসঙ্গে ড. আলিয়া নাহিদ আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ সরকার উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সাশ্রয়ী এই পদ্ধতিটি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করবে।
কোবরা-বিপিএস গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এর জয়েন্ট গ্লোবাল হেলথ ট্রায়ালস স্কিম, মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এবং ওয়েলকাম ট্রাস্ট এর আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালনা করা হয়েছে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা