অনলাইন ডেস্ক
এদের মধ্যে রয়েছে ঘরের মাছি (House fly), ডাঁশ, ফলের মাছি (Fruitfly), সেটসি মাছি (Tsetsefly) ইত্যাদি। মাছিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একজোড়া ডানা এবং পেছনের ডানাজোড়া রূপান্তরিত হয়ে ভারসাম্য রক্ষাকারী হলটেয়ারে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বে মাছির প্রজাতি ও রোগবাহী ভূমিকা
Diptera বর্গে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মাছির প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে শুধু Brachycera উপবর্গেই ৮০,০০০-এর বেশি প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ঘরের মাছি (Musca domestica) এবং ফলের মাছি (Tephritidae পরিবার) কৃষি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। ঘরের মাছি কলেরা, টাইফয়েড ও ডায়রিয়ার মতো রোগ ছড়ায়, অন্যদিকে ফলের মাছি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
মাছির জীবনচক্র
মাছির জীবনচক্র একটি সম্পূর্ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারটি সুনির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে স্ত্রী মাছি পচনশীল জৈব পদার্থ যেমন পচা খাবার, আবর্জনা, গোবর বা মৃত প্রাণীর দেহে ৭৫-১৫০টি ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো সাদা ও ডিম্বাকৃতির হয়, যা অনুকূল পরিবেশে মাত্র ৮-২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফুটে শূককীট (Larva) বের করে।
দ্বিতীয় ধাপে শূককীট বা লার্ভা পর্যায়ে এরা দ্রুত বর্ধনশীল হয়। শূককীটগুলো ক্রিমি সাদা রঙের এবং পচা জৈব পদার্থ খেয়ে ৩-৫ দিনে তিনবার খোলস পরিবর্তন করে।
তৃতীয় ধাপে শূককীট শুকনো ও নিরাপদ স্থানে গিয়ে পিউপা (Pupae) বা গুটিকায় পরিণত হয়। এই পিউপা পর্যায়ে বাদামি রঙের কঠিন আবরণ গঠিত হয়, যেখানে অভ্যন্তরীণ জটিল রূপান্তর প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
চতুর্থ ও চূড়ান্ত ধাপে ৩-৬ দিনের মধ্যে পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মাছি বের হয়ে আসে। প্রাপ্তবয়স্ক মাছি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে, পুরুষ মাছি স্ত্রী মাছির সাথে মিলিত হয় এবং ডিম পারে। এভাবেই তাদের জীবনচক্র পুনরায় শুরু করে।
উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে এই সম্পূর্ণ চক্র মাত্র ৭-১০ দিনে শেষ হয় বলে মাছির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। একটি স্ত্রী মাছি তার ১৫-৩০ দিনের জীবনকালে ৫০০-৯০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম, যা তাদের দ্রুত বংশবিস্তারের প্রধান কারণ। মাছির প্রজাতি ও ঋতু ভেদে এই জীবনচক্র কমবেশি হতে পারে।
মাছির জীবনচক্র একটি সম্পূর্ণ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারটি সুনির্দিষ্ট ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে স্ত্রী মাছি পচনশীল জৈব পদার্থ যেমন পচা খাবার, আবর্জনা, গোবর বা মৃত প্রাণীর দেহে ৭৫-১৫০টি ডিম পাড়ে।
বাংলাদেশে মাছির প্রজাতি
বাংলাদেশে নানাবিধ মাছির প্রজাতি দেখা যায়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঘরের মাছি (Musca domestica), ছোট মাছি (Fannia canicularis), দংশনকারী মাছি (Stomoxys), নীলমাছি বা ব্লোফ্লাই (Calliphora species), গ্রিনবটল ফ্লাই (Lucilia species) এবং ফ্লেশফ্লাই (Sarcophaga species)।
এছাড়া কালো মাছি (Black fly), ডিয়ার ফ্লাই (Deer fly), ঘোড়ামাছি (Horse fly), হোবারমাছি (Hover fly), ক্রেন ফ্লাই (Crane fly) এবং বেলেমাছি (Sand fly) এর মতো প্রজাতিগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়।
মাছির প্রভাব ও ভূমিকা
মাছি সাধারণত ক্ষতিকর প্রাণী হিসেবে পরিচিত। ঘরের মাছি কলেরা ও টাইফয়েডের মতো মারাত্মক রোগ ছড়ায়, অন্যদিকে ফলের মাছি ফল ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে সব মাছি ক্ষতিকর নয়। কিছু প্রজাতি পরজীবী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং ফুলের পরাগায়ণে সহায়তা করে, যা পরিবেশের জন্য উপকারী।
বাংলাদেশে মাছিবাহিত রোগসমূহ
বাংলাদেশে মাছি বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বালিমাছি কালাজ্বরের (Leishmaniasis) জীবাণু বহন করে, যা মানুষের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। Tabanid প্রজাতির মাছি অ্যানথ্রাক্সের (Anthrax) জীবাণু ছড়ায়, যা গবাদি পশু ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
কালো মাছির কামড় পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষভাবে বিরক্তিকর, আর Ceratopogonid মাছি সন্ধ্যায় দংশন করে। Syrphid মাছির লার্ভা অন্ত্রীয় Myiasis রোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং Tephritid প্রজাতির ফলের মাছি দেশের ফল ও শাকসবজির মারাত্মক ক্ষতি করে, যা কৃষি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মাছি থেকে মুক্ত থাকার বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়
মাছি নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো বিজ্ঞানসম্মত সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
প্রথমত, কঠোর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অপরিহার্য, খোলা খাবার অবশ্যই ঢেকে রাখতে হবে, বাসি খাবার ও আবর্জনা নিয়মিত ফেলতে হবে এবং ময়লা পাত্র ও ডাস্টবিন প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসেবে ACI, Baygon বা Hit এর মতো গুণগতমানের কীটনাশক স্প্রে, আলোক ফাঁদযুক্ত ইলেকট্রিক ফ্লাই ট্র্যাপ এবং আঠালো ফ্লাই পেপার (Sticky paper) ব্যবহার করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে মাকড়সা, তেলাপোকা এবং Bacillus thuringiensis ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মাছির লার্ভা ধ্বংস করা যায়।
চতুর্থত, পশু খামারে বায়োসিকিউরিটি মেনে চলা এবং মাছির প্রজননক্ষেত্র যেমন পচা খাবার ও গোবর দ্রুত অপসারণ করা গেলে মাছির বংশবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব।
মাছি প্রতিরোধের কার্যকর ঘরোয়া পদ্ধতি
প্রাকৃতিক উপায়ে মাছি নিয়ন্ত্রণে কিছু সহজলভ্য ঘরোয়া পদ্ধতি কার্যকর। লেবুর টুকরোয় লবঙ্গ গেঁথে রাখলে বা ঘরে বা বারান্দায় পুদিনা, তুলসী ও নিম গাছ রাখলে মাছি স্বাভাবিকভাবেই দূরে থাকে। একটা বাটিতে সিরকা ও ডিশওয়াশ সাবান মিশিয়ে তৈরি ফ্লাই ট্র্যাপ মাছি আকর্ষণ করে ধ্বংস করে।
মাছি পৃথিবীব্যাপী একটি সুপরিচিত কিন্তু উপেক্ষিত পতঙ্গ, যা শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনেই ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং মারাত্মক রোগ ছড়ানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
এছাড়া ইউক্যালিপটাস, পেপারমিন্ট বা ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েলের সুগন্ধ মাছি প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করাও জরুরি, কেননা মাছি অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পছন্দ করে। এসব পদ্ধতি নিয়মিত প্রয়োগ করলে রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই মাছিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।
মাছি পৃথিবীব্যাপী একটি সুপরিচিত কিন্তু উপেক্ষিত পতঙ্গ, যা শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনেই ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং মারাত্মক রোগ ছড়ানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মতো উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর দেশে মাছির প্রাদুর্ভাব এবং রোগবাহী ভূমিকা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে মাছির প্রজাতি ও তাদের রোগবাহী ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা এখনো অপ্রতুল। এই বিষয়ে আরও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন।
মাছির বংশবিস্তার রোধ ও রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় সম্প্রদায়কে সচেতন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, কীটনাশকের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। নাগরিকদের চার্জার অবস্থান থেকে বিজনেস বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
খোলা খাবার ও আবর্জনা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা। মাছির প্রজননস্থল (পচা জৈব পদার্থ) শনাক্ত করে দ্রুত অপসারণ করা। মনে রাখবেন, একটি মাছিমুক্ত পরিবেশ শুধু আরামদায়কই নয়, এটি রোগমুক্ত জীবন নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের সমন্বয়ে আমরা মাছির উপদ্রব থেকে মুক্ত থাকতে পারি এবং একটি সুস্থ সমাজ গঠন করতে পারি। সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা