তাসকিনা ইয়াসমিন
বইটি সম্পর্কে প্রকাশক বলেছেন, কমলা দাসের নিজের এই আত্মজীবনী শুরু হয়েছে চার বছর বয়স থেকে। তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগের অন্তিম অধ্যায়। তিনি পড়েন কলকাতার এক মিশনারী স্কুলে, দেখেন জাত পাতের বৈষম্য, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা। তারপর কৈশোরে বিয়ে, স্বামীর সঙ্গে তিক্ত-বিষম সম্পর্ক, যৌনতার উন্মেষ, লেখিকা হিসেবে আÍপ্রকাশ, পরকীয়া, সন্তানদের জন্ম। ক্রমে স্বামীর সঙ্গে মনো দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন, লেখালেখিতে অখন্ড নিবেশ এবং যৌন মুক্তির প্রতিষ্ঠা ০ এই নিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি।
বইটি সম্পর্কে অনুবাদক বিতস্তা ঘোষাল বলেছেন, কমলার লেখা শুধু একজন মহিলার আত্মজীবনী নয়, তার বাইরে এক সময়ের গল্প, যা স্পষ্টভাবে পাঠককে টেনে রাখে, বাধ্য করে নিজেকে তার সঙ্গে আত্মিক হতে। একজন স্ত্রী, মা, বোন, কন্যা, প্রেমিকা এবং শেষ অবধি এক লেখিকার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির এক পরাধীন নারীর নিজের অস্তিত্ব আবিস্কার বা প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ চেষ্টা, যা যে কোনও নারীরই কাহিনী।
মুল লেখায় ছিল ২৭ টি অংশ। পরে ইংরেজিতে যখন প্রকাশিত হয়, তখন তার কলেবর বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ এ।
তবে এখানে ২৭ টি অংশ রয়েছে। এতে লেখিকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়িতে অবস্থান, স্কুল জীবন, শিক্ষিকারা, স্বামী, প্রেমিক, বন্ধু, মা – বাবা , ভাইয়ের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক, সন্তান, মানসিক হতাশা, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাসহ সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থার নানা চিত্র ফুটে উঠেছে। বইটি আমি হাতে পাই কবি অনুবাদক বিতস্তা ঘোষালের হাত ঘুরে- উপহার হিসেবে। এর আগে পড়েছি তবে, তখন বয়স কম থাকায় মাথায় এতটা ঢুকেনি। যেসব নারীরা যৌনতার বিষয়ে ভীষণ রক্ষণশীল তাদের বইটি পড়ে মাথা ব্যথা করতে পারে। অল্প বয়সী মেয়েদেরও বইটি পড়ে মাথা ব্যথা করার ঝুঁকি রয়েছে।
বইটিতে এই গুণী লেখিকা প্রকাশের সময় কাউকে ছাড় দেননি। তাইতো এটি যখন প্রথম ইনতে কথা নামে ভারতীয় পত্রিকা ১৯৭২ সালে মালয়ানাডু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পরিবারের সদস্যরা অাপত্তি জানিয়েছিল। তারা এটি না প্রকাশ করার জন্য প্রকাশককে চাপ দেয়। কিন্তু প্রকাশক তা ছাপা বন্ধ করেননি। ভারতের নারী লেখিকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত আত্মজীবনী এটি। নিজের মা-বাবার ভালবাসাহীন দাম্পত্য জীবন যে কিভাবে তার এবং ভাইয়ের জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছিল সেটার স্পষ্ট প্রকাশ করেছেন।
আমাদের মেয়েদের চলার পথে প্রায়ই যে মরে যেতে ইচ্ছে – সারাজীবন আমরা যা চাই, আর যে পরিবেশ পাই না তা নিয়ে যুদ্ধ করে কাটাই তার প্রতিটি লেখায় প্রতিটি পরতে পরতে সেই বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। বইটি পড়ার সময় বা পড়ার পর প্রায় সব পাঠকই কাঁদবেন – কারণ কমলার জীবনের কোন না কোন অংশের সঙ্গে তার জীবন মিলে যেতে বাধ্য। কমলা ব্রিটিশ ভারত এবং স্বাধীন ভারতের জীবন যাপন করেছেন কিন্তু সেই সময়ের বাস্তবতার এখনো অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
বিশেষ করে বিবাহিত নারীর যৌন জীবন যাপন এবং স্বামীর সঙ্গে বাঙালি নারীদের জীবন যাপন এখনো কমলার সময়ের মতোই সহজ হয়নি। তিনি নিজেই ছিলেন মালয়ালম লেখিকা, কলকাতায় থাকার সুবাদে বাঙালিদের বিষয়েও লিখেছেন। তার এই বই সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্য হতে পারে।
অনুবাদক বিতস্তা ঘোষালের ভাষায়- নারীর চাহিদা, ভালবাসা, সম্পর্ক, যৌনতা, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ও তার থেকে উত্তরণের কাহিনী নিয়ে লেখা আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’ আগাগোড়া আকৃষ্ট করে রাখে পাঠককে।
কমলা দাস তার শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘পড়ন্ত সূর্যাস্তের আলোয় আমরা নিজেদের ভগবান ভাবতাম যারা ভুল করে কোনও অজানা নিষ্ঠুর গ্রহে এসে পড়ে থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছে…’
বইটি আমার মতো কম ইংরেজি জানা বাংলাভাষীদের জন্য অনুবাদ করে ধন্য করেছেন বাংলাভাষী কবি ও অনুবাদক বিতস্তা ঘোষাল। বাংলাদেশে বইটি প্রকাশ করেছে চিত্রা প্রকাশনী। উৎসর্গ করা হয়েছে কবি, বহুমাত্রিক লেখক সাযযাদ কাদিরকে।
কমলা দাস
ভারতের প্রখ্যাত কবি ও কথাশিল্পী কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯)। কমলা সুরাইয়া ও মাধবকুট্টি নামেও পরিচিত।একজন নারী তখনই সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠেন যখন তিনি পরিপূর্ণভাবে কোনও পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, পুরুষ ছাড়া নারী অসম্পূর্ণ- ২০০৯ সালে মৃত্যুর আগে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই কথাটি বলেছিলেন বিখ্যাত এই লেখিকা। ১৯৩৪ সালে কেরল’র ঐতিহ্যবাহী রাজবংশে কমলার জন্ম। ১৫ বছর বয়সে মাধব দাসের সঙ্গে বিযের পর শুরু হয় তার সক্রিয় লেখালেখি। মালয়ালম ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ এই লেখিকার। রক্ষণশীল হিন্দু নায়ার (নাল্লাপাট্টু) পরিবারের সদস্য্ ১৯৯৯ সালে ৬৫ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি গ্রহণ করেন কমলা সুরাইয়া নাম। সেই বছরের ১৬ ডিসেম্বর রাজ্যের মুসলিম লিগ এমপি, ৩৮ বছর বয়সী সাদিক আলি (আবদুস সামাদ সামদানি)’র সঙ্গে বিবাহ এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে তার বিয়ে হয়। সামাজিক-সাহিত্য মহলে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করে এই ধর্মান্তর। ভারতীয় প্রখ্যাত পত্রিকা দ্য হিন্দু লিখেছিল, ঘটনাটি অন্য কিছু নয় – তাঁর আরেক ‘চমক মাত্র’।
কমলা দাসের বিখ্যাত আত্মজীবনী মাই স্টোরি ছাড়াও বিখ্যাত গ্রন্থ Alphabet of Lust (1977), Padmavati, the Hariot and Other Story (1992), Peom Summer in Calcutta(1965), The Descendants (1992), Only the Soul knows How to sing (1996), The kept Women and other Stories etc. তিনি একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর লেখনীর জন্য, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেন পোয়েট্রি প্রাইজ, সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার। ভারতীয় একটি পত্রকিা তাকে ইংরজেি কবতিার জননী হসিবেে উল্লখে করছেনে। ১৯৮৪ সালে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর লেখা স্প্যানিশ, রাশিয়ান, জার্মান ও জাপানিতে অনুদিত হয়েছে।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন তিন সন্তানের মা। ২০০৯ সালের ৩১ মে পুনের একটি হাসপাতালে ৭৫ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয় কেরল’র রাজধানী তিরুবানন্তপুরম – এর পালায়াম জামা মসজিদ চত্বরে।
বিতস্তা ঘোষাল
জন্ম কলকাতায়। পিতা ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘মাতা কুসুমকুমারী ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার’, ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’প্রাপ্ত বৈশম্পায়ন ঘোষাল। মা সোনালী ঘোষাল স্কুল শিক্ষিকা, অনুবাদক। বিতস্তার স্বামী সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। একমাত্র কন্যা লিচ্ছবী। তিন বোনের মধ্যে বড় মণিপুরী নৃত্যশিল্পী বিতস্তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম, এ রবীন্দ্রভারতী থেকে বি লিস পাশ করে কলেজে অধ্যাপনা করেন কিছুদিন। ভাল না লাগায় ছেড়ে দিয়ে নিয়োজিত হয়েছেন লেখালেখি, সাংবাদিকতায়। অনুবাদ সাহিত্য একমাত্র পত্রিকা অনুবাদ পত্রিকার বর্তমানে সম্পাদক। নিয়মিত অনুবাদ চর্চার পাশাপাশি মৌলিক লেখাও অব্যাহত। একাধিক পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা বিতস্তার কবিতা ইংরেজি, ওড়িয়া ও হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে। ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমির ইন্ডিয়ান লিটারেচার – এ তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। ২০১২ তে অনুবাদ পত্রিকার জন্য বাংলা একাদেমী সম্মান ও ২০১৪ তে একান্তর কথা সাহিত্যিক পুরস্কার প্রাপ্ত বিতস্তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘একা এবং রঙিন হলুদ বিকেলের গল্প’, ‘নিস্তব্ধতা’, ‘রুপকথার রাজকন্যা’, উপন্যাস – ‘ছিন্ন পালের কাছি’ ও ‘ঘেরাটোপের নীল অতলে’, কবিতা সংকলন – ‘অপ্রেমের প্রবেশপথ’ ও ‘বৃষ্টিভেজা শব্দরা’।
অনূদিত গ্রন্থ কর্তার সিং দুগগলের ‘নির্বাচিত গল্প সংকলন’। এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা ‘বিবেকানন্দ : প্রতিদিনের চলার শক্তি’। ২০১৬ – এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘এলোমেলো গদ্যের খসড়া’। বিতস্তার একমাত্র স্বপ্ন ও চাহিদা মানুষকে ভালবাসা। তাঁর নিজের কথায় ‘ভালবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে?’
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা