মশা মারার ওষুধ অকার্যকর জানার পরও ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০১৮ সাল জাতীয় নির্বাচনের বছর ছিল বলে ওষুধ অকার্যকর হওয়ার বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিলেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এবার মশা বাড়বে—স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এমন সতর্কবার্তাও সিটি করপোরেশন কানে নেয়নি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই মশার ওষুধ কেনাকাটায় রয়েছে নানা অসংগতি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে মশার ওষুধ নিয়ে এমন অবহেলা, অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলছেন। তবে দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সিন্ডিকেটের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, উত্তর আর দক্ষিণের কেনাকাটায় ভিন্নতা আছে।
এখন ঢাকার ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এসব রোগীর বেশির ভাগই ঢাকা থেকে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ওষুধ পরিবর্তন করার কথা বলছেন। তবে এরই মধ্যে ওষুধ সরবরাহকারীরা লাভ যা করার তা করে নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উত্তর সিটি করপোরেশন মশকনিধনে ১৪ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। আর দক্ষিণ সিটি ওষুধ কিনতে ব্যয় করেছে ১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অথচ এই দুই সিটি করপোরেশন মিলে দেশবাসীকে অশেষ দুর্গতিতে ফেলেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দুই সিটি করপোরেশনে মশা মারার ওষুধ কেনা নিয়ে নানা অসংগতি ধরা পড়েছে। বর্তমানে দুটি প্রতিষ্ঠান দুই সিটি ভাগ করে ওষুধ বিক্রি করে। উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা নোকন নামের একটি কৃষি ও কীটনাশক বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওষুধ কিনছে। আর লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ওষুধ দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) মশকনিধনের ওষুধ পরীক্ষা করে বলেছে, এটি অকার্যকর। একই ওষুধ পরীক্ষা করে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) বলেছে অকার্যকর। উত্তর সিটি করপোরেশন লিমিটের ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় অকার্যকর বলে বাতিল করেছে। উত্তরের বাতিল করা ওষুধ দক্ষিণে ব্যবহৃত হচ্ছে।
লিমিটের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি লিমিটের ম্যানেজার ছিলেন। মালিকেরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পর তিনিসহ কয়েকজন এখন লিমিটের মালিক। সাদেক হোসেন খোকা ও মোহাম্মদ হানিফ যখন মেয়র ছিলেন, সে সময়ও তাঁরা ঢাকা সিটি করপোরেশনে মশার ওষুধ বিক্রি করেছেন। দুই সিটি ভাগ হওয়ার পরও করছেন।
একসময় দেশের একটি বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসিআইসহ কিছু প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে মশা মারার ওষুধ বিক্রি করত। এসিআইয়ের একজন কর্মকর্তা ও দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেছেন, নানা চাপে তাঁরা আর মশার ওষুধ বিক্রি করেন না।
একজন মালিক বলেছেন, ‘এখন সরকারি কেনাকাটার প্রায় সব জায়গাতেই সিন্ডিকেট। তবে সিটি করপোরেশনে, বিশেষ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অত্যন্ত আগ্রাসী সিন্ডিকেট। এখানে মান ঠিক রেখে ওষুধ বিক্রি করে লাভ হয় না।’
কার ওষুধ কে সরবরাহ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এখন মশা মারতে ‘লিমিট লিকুইড ইনসেক্টিসাইড পিএইচপি-২০৫’ ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ওষুধ লিমিটের তৈরি। আর ওষুধটি দেয় নারায়ণগঞ্জের সরকারি প্রতিষ্ঠান ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দরপত্র ছাড়াই কাজ পাচ্ছে।
কীটনাশক আইন, ১৯৮৫ ও কীটনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১ বলছে, নিবন্ধনহীন কোনো প্রতিষ্ঠান কীটনাশক আমদানি, তৈরি, বিক্রি, বিক্রির প্রস্তাব করতে পারবে না।
কীটনাশক ব্যবসার নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ডকইয়ার্ডের নাম পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ডকইয়ার্ডের নিবন্ধন নেই। তা হলে তারা কীভাবে ওষুধ দেয়?
এই প্রশ্নের জবাবে দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড ও সিটি করপোরেশন দুটোই সরকারি প্রতিষ্ঠান। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করার সুযোগ আছে। তারা নিবন্ধিত কি না, এটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমি রিকুইজিশন দিচ্ছি, ওষুধ পাচ্ছি। আমি খুশি।’
কিন্তু সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. মনজুরুল হান্নান ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কৃষিসচিবকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ডকইয়ার্ডের ব্যবসা অবৈধ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডকইয়ার্ড সরাসরি ওই ওষুধ দেয় না। তাদের নিবন্ধিত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিট থেকে ওষুধ নিয়ে সিটি করপোরেশনের ঢাকেশ্বরীর মশক নিবারণী দপ্তরের গুদামে দেয়।
এক ওষুধ থেকে লাভ করে লিমিট, বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ও ডকইয়ার্ড। তবে লিমিট কত টাকা লিটার দরে ডকইয়ার্ডের কাছে ওষুধ বিক্রি করে, তা জানা যায়নি।
তবে কাগজপত্রে আছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতি লিটার ৩৭৮ টাকা দামে ৭ লাখ লিটার মশা মারার ওষুধ দেওয়ার কাজ পায় ডকইয়ার্ড।
যেভাবে উত্তর ছাড়ল লিমিট লিমিটের ওষুধ দক্ষিণ সিটি কিনছে প্রতি লিটার ৩৭৮ টাকা দামে। সেই লিমিট গত বছর অক্টোবরে উত্তর সিটির কাছে প্রতি লিটার ২১৭ টাকা দামে ওষুধ বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। উত্তর সিটির কাছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ লিটার মশা মারার ওষুধ বিক্রিতে লিমিট, নোকনসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পায় লিমিট।
এ বছর জানুয়ারি মাসে লিমিট ৬৫ হাজার লিটার ওষুধ দেয়। লিমিটের ওষুধ মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। উত্তর সিটির কর্মকর্তারা লিমিটের কার্যাদেশ বাতিল করেন এবং এক বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেন।
লিমিটের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তর সিটি করপোরেশনের ক্রয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা মাঠ পরীক্ষার সময় কারসাজি করে আমার ওষুধকে খারাপ প্রমাণ করেছিলেন। আমার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে একচ্ছত্র সুবিধা দেওয়ার জন্য তাঁরা আমার প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করেন।’
এরপর উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে ওষুধ বিক্রির সুযোগ পায় নোকন। নোকন প্রতি লিটারের দাম ধরেছিল ২৫৯ টাকা। প্রথমে তারা ১ লাখ লিটার ওষুধ বিক্রি করে। এরপর তারা আরও ৩ লাখ লিটারের কাজ পায়। কারণ, আর কেউ দরপত্রে অংশগ্রহণ করেনি। ওষুধ সরবরাহের এই কাজগুলো হয়েছে মেয়র আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর এবং আতিকুল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার আগে।
গুলশানে নোকনের কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মো. খালিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তাঁরা কোনো দিন কাজ পাননি।
২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছিল, নোকন নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে, কাজ পাওয়ার জন্য জালিয়াতি করে, বিদেশে মুদ্রা পাচার করে। আরও কিছু গুরুতর অভিযোগ ওই প্রতিবেদনে আছে।
প্রতিবেদন সম্পর্কে মো. খালিদ হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
বাতিল ওষুধ গেল কোথায় মাঠ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া ওষুধ কোনো কাজে লাগে না। নিয়ম হচ্ছে, ওষুধ ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু উত্তর সিটি বাতিল হওয়া ওষুধ ধ্বংস করেনি। লিমিট সেই ওষুধ দক্ষিণ সিটিকে দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইং এবং আইইডিসিআর সেই ওষুধ পরীক্ষা করেছে। দুটি প্রতিষ্ঠানই বলেছে, ওষুধ কার্যকর। তবে ওষুধ পরীক্ষার নমুনা কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে।
উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, নতুন ওষুধ কেনার আগ পর্যন্ত পরিমাণ বাড়িয়ে এখনকার ওষুধটি তাঁরা ব্যবহার করবেন। সিন্ডিকেট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মশার ওষুধ পুরোপুরি একটি সিন্ডিকেটের অধীনে। এখন সিন্ডিকেটকে বাদ দিয়ে উত্তর সিটি সরাসরি ওষুধ আমদানি করবে।’ তবে তিনি সিন্ডিকেটে কারা আছে, তাদের নাম বলেননি।
অসাড় সিটি করপোরেশন দুই সিটি করপোরেশন স্বচ্ছতার সঙ্গে ওষুধ কেনার ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দেয়নি, তেমনি বিজ্ঞানীদের তথ্যের প্রতিও তারা চরম অবহেলা দেখিয়েছে।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস মশা প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহারে মরছে না। ঢাকা শহরের এডিস মশা ওষুধপ্রতিরোধী।
গত বছরের ২২ মে এই গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ২১ জন। তাঁদের তিনজন প্রথম আলোকে বলেছেন, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, এটা নির্বাচনের বছর। ওষুধ অকার্যকর হওয়ার কথা যেন চারদেয়ালের বাইরে না যায়।
এরপর সিডিসি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে রাজধানীর সাতটি এলাকার কিউলেক্স মশা নিয়ে গবেষণা করে। ওই গবেষণাতেও ওষুধের অকার্যকারিতা ধরা পড়ে।
এ ছাড়া এ বছরের মার্চ মাসে ঢাকা শহরে মশা জরিপ শেষে তার ফলাফল প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। তখন তারা সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে বলেছিল, আগে থেকে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মশা আরও বাড়বে।
ধারাবাহিক অবহেলা ও গাফিলতির কারণে বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই পর্যায়ের অবহেলা অপরাধের সমান। মশার ওষুধ কেনায় সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়টি উত্তর সিটি স্বীকার করেছে। দক্ষিণেরও এটা স্বীকার করে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
NB:This post is copied from prothomalo
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা