অনলাইন ডেস্ক
তিনি মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং তাদের সরল, সঠিক ও শান্তির পথে পরিচালিত করেন। যাতে তারা জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে আর ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হয়। নবী করিম (সা.)-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭) মহানবী (সা.)-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। দল-মত-গোত্রনির্বিশেষে আরবের জাতি-ধর্ম-বর্ণ—সবার মধ্যে শান্তিচুক্তি ও সন্ধি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অনুপম চরিত্র-মাধুর্য ও সত্যনিষ্ঠার কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি যুদ্ধবাজ আরবদের শান্তির পতাকাতলে সমবেত করেন এবং বিবদমান গোত্রগুলো একটি সুসংহত জাতিতে রূপান্তরিত হয়।
নবুয়তের দ্বাদশ বর্ষে হজের সময় মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) মদিনা থেকে মুসলিমদের বড় একটি কাফেলা নিয়ে মক্কায় আসেন। ১২ জিলহজ রাতের তৃতীয় ভাগে তারা আকাবা নামক স্থানে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করেন। সংখ্যায় তারা ছিল ৭৫ জন। ৭৩ জন পুরুষ এবং দুজন নারী। সৌভাগ্যবান দুই নারী হলেন উম্মে আম্মারা নাসিবা বিনতে কাব (রা.) এবং উম্মে মানি আসমা বিনতে আমর (রা.)। এই সাক্ষাতে তারা নবীজি (সা.)-কে মদিনায় হিজরতের আমন্ত্রণ করেন এবং তাঁকে রক্ষায় জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করে। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮০)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.)—যদিও তখনো মুসলিম হননি। তিনি মদিনাবাসীর সামনে মক্কার পরিস্থিতি ও মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘মুহাম্মদের মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জানো। আমাদের গোত্রের মধ্যে যারা মুহাম্মদ প্রবর্তিত ধর্ম বিশ্বাস সমর্থন করে না, মুহাম্মদকে আমরা তাদের কাছ থেকে দূরে রেখেছি। নিজ শহরে স্বগোত্রীয়দের মধ্যে তিনি নিরাপদে আছেন। তিনি তোমাদের কাছে যেতে চান, তোমাদের সঙ্গে মিশতে চান। যদি তোমরা তাঁর নিরাপত্তা দিতে এবং শত্রুপক্ষের হামলা থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারো তবে কিছু বলার নেই। তোমরা যে দায়িত্ব নিয়েছ সে তোমরাই ভালো জানো। কিন্তু যদি তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে থাকো, তবে এখনই চলে যাও।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৬২)
আব্বাস (রা.)-এর কথা শেষ হলে কাব (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আল্লাহ আমাদের কাছে কোন বিষয়ে বাইআত বা অঙ্গীকার চান। তিনি তা বর্ণনা করেন। আব্বাস ইবনে উবাদা আনসারি (রা.) মদিনাবাসীকে এই অঙ্গীকারের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন, তোমরা বুঝতে পারছ তোমরা কিসের অঙ্গীকার করছ? তোমরা আরব ও অনারবের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকার করছ। সেদিন যদি তোমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসো, তবে এখনই অঙ্গীকার ছেড়ে দাও। সাহাবিরা তখন আবারও নিজের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন এবং বাইআতের জন্য অগ্রসর হন। সর্বপ্রথম বাইআত গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন আসআদ ইবনে জুরারা (রা.)। পরবর্তী সময়ে অন্যরা শপথ গ্রহণ করে। পুরুষরা নবীজির হাতে হাত রেখে এবং নারীরা মৌখিকভাবে বাইআত গ্রহণ করেছিল। ইসলামের ইতিহাসে একে আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়। (সিরাতে মোস্তফা : ১/৩৩২ ও ৩৩৭)
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে অঙ্গীকার গ্রহণকারী মুসলিমরা নিজেদের মধ্য থেকে ১২ জন নকিব বা নেতা মনোনীত করেন। তারা হলেন, ‘আসআদ ইবনে জুরারা, সাদ বিন রাবি, সাদ বিন উবাদা, উসাইদ বিন হুদায়ের, আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা, বারা বিন মারুর, উবাদা বিন সামিত, রাফি বিন মালিক, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, মুনজির বিন আমর, সাদ বিন খায়সামা, আবুল হায়সাম মালিক বিন তাইয়িহান (রা.)। নির্বাচিত সাহাবিদের ৯ জন খাজরাজ থেকে এবং তিনজন আউস গোত্রের ছিলেন। তাঁরা পুনরায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ১/৩৮১)
আল্লামা ইদরিস কান্ধলভি (রহ.)-এর মতে আকাবার দ্বিতীয় শপথের ব্যাপারে নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে—এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, নিধন করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইনজিল ও কোরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং এটাই তো মহাসাফল্য।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১১১; সিরাতে মোস্তফা : ১/৩৩৪)
বাইআত শেষ হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) কাফেলাকে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল হতে হতে কোরাইশরা শপথের কথা জানতে পারল এবং একটি বিরাট দল নিয়ে মদিনাবাসীদের ঘিরে ধরল। কিন্তু কাফেলার মুশরিকরা তাদের নিশ্চিন্ত করল এখানে এমন কিছু হয়নি এবং তাহলে অবশ্যই তারা জানতে পারত বলে আশ্বস্ত করল। অবশ্য কোরাইশরা অনুসন্ধান করে জানতে পারল ঘটনা সত্য। তখন তারা মদিনা থেকে আগত কাফেলার পিছু নেয়। কিন্তু ততক্ষণে তারা নিরাপদ স্থানে চলে এসেছে। শুধু সাদ ইবনে উবাদা (রা.)-কে ধরতে পারল। তারা তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন করল। অবশেষে জুবায়ের ও হারিস নামক দুই ব্যক্তি যাদের সিরিয়ায় যাওয়ার পথে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের সহায়তায় তিনি মুক্তি পেলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ১২০-১২১)
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা