মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৭১তম বার্ষিকী উদযাপন
অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সহিষ্ণু সমাজ গঠনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও সংলঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী। এসব মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর ২০১৯) ঢাকায় আয়োজিত ‘স্পিক আপ ফর ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন, ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন/বিলিফ এ্যান্ড মাইনরটিজ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তারা একথা বলেন।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৭১তম বার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং মত প্রকাশের অধিকার বিষয়ক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ডেনমার্ক দূতাবাস এ অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন।
অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, বর্তমান কমিশন মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখছে। সম্প্রতি কমিশনের সঙ্গে আর্টিকেল নাইনটিনের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া কমিশন ইতিমধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক কমিটির পুনর্গঠনে কাজ শুরু করেছে। এ কাজে আর্টিকেল নাইনটিনসহ অন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যুক্ত করা হবে।’
বাংলাদেশে ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমাজের মূল ভিত্তি। এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য মত বিনিময় নয়; বরং মানুষের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিক ক্ষমতায়নের প্রকাশই হচ্ছে বাক স্বাধীনতার লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, এটা এমন একটা অধিকার যা একটি সমাজ অবিচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ’না’ বলতে সক্ষম।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি নুসরাত হত্যা, আবরার হত্যা এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ’মুক্ত গণমাধ্যম ধারণা সরকারের জন্য সব সময় অনুকূল নাও হতে পারে। তিনি সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে গঠনমূলক সমালোচনা ও মুক্ত আলোচনার পরিসর নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সাংবাদিক, ব্লগার, মানবাধিকার এবং নাগরিক সংগঠন নিজেদের দায়িত্ব যাতে হুমকি ও ভয়ভীতি এড়িয়ে পালন করতে পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী। মিয়ানমারের রাখাইনে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের কারণে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিস্থিতির তুলনায় বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের ‘বাতিঘর’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বহু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, বিভিন্ন বিশ্বাস ও ধর্মীয় মতাবলম্বী মানুষ থাকা সত্তে¦ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আর্টিকেল নাইনটিনের ২০১৯ সালের বৈশ্বিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য (গ্লোবাল এক্সপ্রেশন রিপোর্ট) তুলে ধরে বাংলাদেশ সংগঠনটির বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চায় বাংলাদেশ পিছিয়ে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের অগ্রগতিকে ম্লান করেছে। এসডিজির ১৬ নম্ব অভীষ্টে সুশাসন তথা শান্তি, ন্যায়বিচার, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যটি অর্জনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিয়া আমির বলেন, মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের সংবিধান গোটা বিশ্বে অনন্য। সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দুই ভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। সরকার ও এর বাইরের প্রভাবশালী শক্তি বিভিন্ন সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করে। আবেদ খান বলেন, সংখ্যাঘুদের সুরক্ষার বিষয়টি স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক ইস্যু। বাংলাদেশে ধর্ম বা বিশ্বাসের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু এ বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমরা ‘সেলফ- সেনসরশিপ’ আরোপ করি। ধর্ম বা বিশ্বাস বিষয়ক কোন আলোচনা মুক্ত পরিসরে করার সুযোগ এখন নাই। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং চরমপন্থীদের আক্রমনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সনদের প্রায় সবকটিরই বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার সুরক্ষায় যে পরিমাণ প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ দিয়েছে, বাস্তবে সেসবের প্রতিফলন কম। মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সচেতনতা প্রয়োজন। মত প্রকাশের স্বীকৃত মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি উসকানিমূলক কিছু প্রচার করে তার প্রতিবাদ যেমন হবে, তেমনি এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে নতুন আবার কোন অপরাধ যাতে সংঘটিত হয় সেদিকেও নজর দেয়া উচিত।
ন্যায় সংগত প্রতিবাদের ক্ষেত্রে যাতে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ না ঘটে সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমস্বয়কারীর কার্যালয়ের সিনিয়র হিউম্যান রাইটস এডভাইজার হেইকে আলেফসেন। তিনি বলেন, যে কোন বিষয়ে মুক্ত নাগরিক আলোচনার অধিকার এবং প্রতিবাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী।
মূল আলোচনা পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আবেদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রীম কোর্টেও আইনজীবী তানিয়া আমির, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমস্বয়কারীর কার্যালয়ের সিনিয়র হিউম্যান রাইটস এডভাইজার হেইকে আলেফসেন এবং মুক্ত প্রকাশ- ফোরাম ফর ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের (ফেক্সবি) চেয়ারপার্সন সৈয়দা আইরিন জামান।
একাত্তর টেলিভিশনের কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স এডিটর মিথিলা ফারাজানা আলোচনা পর্ব সঞ্চালন করেন। অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, অনলাইন এক্টিভিস্ট, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন এনজিওর প্রতিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন : রাজাকার যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তখন খুব খারাপ লাগে : আব্দুস সামাদ তালুকদার
লালসবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা