ইএসপিএনক্রিকইফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম। শুরু থেকেই ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস বিশ্বকাপে ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। এছাড়াও পেশাগত কারণেই টাইগারদের ক্রিকেটের অনেক ভিতর ও বাইরের খবর তার নখদর্পণে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন মাটিতে লুটিয়েছে। দল দেশে ফিরে গেছে। এই ব্যর্থতার দায় প্রায় পুরোটাই চেপেছে কোচিং স্টাফের ওপর। তাই ধারণা করা হচ্ছিল দলের কোচিং স্টাফে আসবে বড় ধরনের পরিবর্তন। হয়েছেও তাই, প্রধান কোচ স্টিভ রোডসকে বিদায় করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ ও ফিজিও থিহান চন্দ্রমোহনের বিদায় নিশ্চিত। আগামী বছর ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হবে অস্ট্রেলিয়াতে। এই মুহূর্তে এত বড় পরিবর্তন কতটা প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশ দলের উপর! কেন কোচদের উপর ভরসা রাখতে পারে না বিসিবি? সেই সঙ্গে ক্রিকইনফোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ দলের এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স নিয়ে দৈনিক মানবজমিন-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সেই কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে কেন বাংলাদেশ দল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলো না? ইসাম: ছোট ছোট অনেক ভুল আর সীমাবদ্ধতা। আমার কাছে মনে হয় একটা দলের চিন্তা-ভাবনাতে যখন সীমাবদ্ধতা থাকে তখন তার প্রতিফলন ঘটানো কঠিনই হয়। যেমন ধরেন রান নেয়ার ক্ষেত্রে, জুটি তৈরি করা আর সবচেয়ে বড় হলো ফিল্ডিং। আসলে ক্রিকেটে ফিল্ডিংটা কিন্তু দলের যখন খারাপ হয় তখন সেটা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ধরেন একজন মিস ফিল্ড করছে তখন দেখা যায় সাকিব করছে, তামিমরাও ক্যাচ ফেলছে! গোটা বিশ্বকাপে আমি দেখলাম যেদিন দল ভালো খেলে সেদিন ফিল্ডিংসহ সবকিছুই ভালো হয়। আর যেদিন খারাপ হয় আমার যেন মনে হয় তারাই দিনটি ঠিক করে নেয় যে, আজ খারাপ যাবে। হ্যাঁ, বড় প্লেয়ারদের পারফরম্যান্স যেমন জরুরি, তেমনি দল হিসেবে ভালো করতে হলে ফিল্ডিংটাও দারুণভাবে করতে হয়। আমাদের এই ব্যর্থতার পেছনে ফিল্ডিং বেশ দায়ী। এরপর আরেকটা বিষয় ৩০ থেকে ৪০ ওভারের মধ্যে সব দলই কিন্তু ৭ বা সাড়ে ৭ করে রান তোলে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ ৬ এর বেশি যেতে পারেনি। তার মানে আপনি কখনো চিন্তা করতে পারবেন না যে, ৩৫০ বা তার বেশি হবে। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো বড় হতে হতে আজ কিন্তু এই ৮ নম্বরে এসে আমরা শেষ করলাম। এতটা খারাপ আশা করা যায়নি।
প্রশ্ন: দলে এত ইনজুরি, বিশেষ করে সিনিয়র ক্রিকেটারদের। দল গঠনের আগে বিসিবি’র নজরে কি তা বড় আকারে আসেনি? ইসাম: অবশ্যই বিসিবি’র নজরে ছিল। কিন্তু আসলে বিকল্পও ছিল না। কাকে বাদ দেবে? যদি ইনজুরির কারণে মাশরাফিকে বাদ দিত তাহলে তো তামিম, সাকিবদের ওপর আরো চাপ বাড়তো। সবার ধারণা ছিল যে, এত কষ্ট করে বিশ্বকাপে আসছি বিশ্বকাপে খেলতে হবে। বোর্ড অবশ্যই সবার কাছে জানতে চেয়েছে তারা পারবে কি না। তবে আমার কাছে মনে হয় এখানে আমাদের ফিজিওর বেশ সমস্যা ছিল। আমি সাংবাদিক হিসেবে এটা বলতে পারি। আমি যতটা শুনেছি ফিজিওর গাফিলতি ছিল। আমি যতটা জানি ক্রিকেটাররাও এটা বেশ অপছন্দ করতো।
প্রশ্ন: তাহলে কোনো ফিজিওর কাছেই ভালো সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না কেন? ইসাম: আগে একজন ভালো ছিল ভিভাব সিং। শুনেছি তাকেই এখন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আসলে ফিজিও নির্বাচনে বিসিবি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে চয়েস করে না। আমার মনে হয় তারা খুব একটা দেখে শুনে আনে না। মানুষের কথা শুনে বাছাই করে। যেমন এই ফিজিও থিহান, তাকে আনা হয়েছে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পছন্দে। আমি মনে করি বিসিবি’র উচিত না, বিদেশি হলেই ফিজিও নিতে হবে। আমাদের দেশেও অনেক ভালো ভালো ফিজিও আছেন। কিন্তু দেশি ফিজিও নিতে চায় না। আমাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে বিদেশি হলেই ভালো!
প্রশ্ন: কোচদের ওপর দায়টা বর্তাচ্ছে। আসলে যারা কোচ ছিলেন তাদের নির্বাচনটা কতটা সঠিক ছিল? ইসাম: বিশ্বকাপের দেড়বছর আগে আমাদের প্রধান কোচ চলে গিয়েছিলেন। এরপর যতটা জানি ১১ জন বিসিবি’র কোচ হতে রাজি হননি। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে ফিল সিমন্স যাকে ধরা হয় ক্রিকেট বিশ্বের সেরা কোচদের একজন তিনি আবেদন করেছিলেন কিন্তু তাকে নেয়া হয়নি। এখানে বিসিবি’র গাফিলতি হয়েছে তা বলবো না, আসলে তাদের এখানে ইগোটাই কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। যাকে নিলেন (রোডস) যে তার ব্যবহার যেন হাথুরুসিংহের মতো না হয়। ব্যবহার ভালো, আপনি তা পেয়েছেন। কিনু্ত আমি মনে করি ব্যবহার ভালো হলেই কোচ ভালো হবে- তা ঠিক নয়। তার কোচিং কতটা ভালো জানি না। তবে তাকে নিয়ে যতটা জানি ক্রিকেটাররাও ভালো কিছু বলেনি। আমার কথা হচ্ছে- চেষ্টা থাকা উচিত ছিল এমন যে যার কাজে দারুণ কিছু থাকবে। যেমন, হাথুরুসিংহের কাজ ভালো ছিল। কিন্তু তার ব্যবহার ভালো ছিল না। আসলে কোচের কাছ থেকে বিসিবি কী চায়- সেটি হয়তো নিজেরাই জানে না ঠিকমতো।
প্রশ্ন: অভিযোগ আছে কোচের কাছ থেকে শেখার ক্ষেত্রে ক্রিকেটারদেরও সীমাবদ্ধতা আছে? ইসাম: হ্যাঁ, এটাই অনেকটা সত্যি। যেমন অনেকের কোচিং তারা নিতে পারে না যেমন কোর্টনি ওয়ালশের ক্ষেত্রে। তার মতো গ্রেটের কাছ থেকে যদি আপনি না নিতে পারেন আর পিছনে গালি দেন তাহলে তো হবে না। ওর কাছে সঠিকভাবে বসতে পারলেতো আর কিছু দরকার ছিল না। কিন্তু আমরা সেটি করি না। আমাদের মনে হয় কোচ হয়তো সব গুলিয়ে খাইয়ে দেবেন। আসলে তারা একজন বড় নামি কোচ চেয়েছিল কিনু্ত তার কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। আমার মনে হয় এখন চাম্পাকা রামানায়েকেকেই এখন রাখা হবে। কারণ তিনি আগেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
প্রশ্ন: স্টিভ রোডসের বিষয়ে আপনার ধারণা? ইসাম: আসলে আমার যে ধারণা স্টিভ রোডস সম্পর্কে তা হলো তিনি একাডেমির জন্য ভালো কোচ। এটা সবাই বলে। আসলে আমরা যে ধরনের কোচ চাই তিনি কিন্তু তেমন নন। ক্লাব লেভেলে যেমন কোচিং দরকার তিনি হয়তো সেরকমও নন।
প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে কোচের পরিবর্তন হলো। এখন করণীয় কী? ইসাম: এখন কিছুই করার নাই? কি করা যাবে! আপনি একজন কোচকে রেখেছিলেন তাকে সময় দিতেন। পর্যাপ্ত সময় দিলে হয়তো তার কাছে ভালো ফল আশা করা যেত। কারণ এক-দেড় বছর না দেখলে কতটা ভালো করতো তা বলা যায় না আসলে।
প্রশ্ন: মাশরাফির বিদায় নিয়ে যত আলোচনা আপনি কীভাবে দেখেন? ইসাম: মাশরাফির বিষয়টা আমাদের জন্য বেশ ধোঁয়াশাতে। কারণ তিনি নিজে কী চান সেটি আমরা জানি না। তিনি শুধু আমাদের জানিয়েছেন যে, এটি তার শেষ বিশ্বকাপ। এখন যেটি আমি শুনেছি যে, বোর্ড হয়তো তাকে মিরপুরে একটি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে দেবে। সেখানে খেলেই তিনি ওয়ানডে থেকে বিদায় নেবেন। কারণ জানেন তো মিরপুরের প্রতি মাশরাফির একটু আলাদা মায়া আছে। হয়তো সেই কারণেই দেশের মাটিতে তিনি শেষ খেলাটা খেলতে চাইছেন?
প্রশ্ন: দলের তরুণদের সম্ভাবনা কতটা দেখলেন? ইসাম: সৌম্য ও লিটন বেশ ভালো ক্রিকেটার। কিন্তু তারা এখনো এতগুলো ম্যাচ খেলেও ধারাবাহিক হতে পারেনি। আমি জানি না এতগুলো ম্যাচ খেলার পরও তাদের কেন এমন অবস্থা। আর সাব্বিরের ব্যাপারটা বুঝতে কষ্টই হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমি দেখি না যে, তার মধ্যে বড় ক্রিকেটার হওয়ার কিছু আছে। যদিও ভালো ফিল্ডার সে, হাতে হিটও দারুণ। তবে সাব্বিরের বিকল্পও পাওয়া যায়নি। আসলে ওকে অধিনায়কসহ দলের সবাই বিশ্বাস করে। আসলে প্যাকেজ দেখলে ওকে নিতে হয়। কিন্তু এই লেভেলে ও ঠিক আছে বলে আমিও মনে করি না।
প্রশ্ন: এই বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দল বাঁচাতে বিসিবি’র করণীয়? ইসাম: আমি মনে করি তাদের এখন অনেক বেশি ধৈর্য্যশীল হতে হবে। এখন এমন ভূমিকা থাকতে হবে যে কাউকে শেষ করে দেয়া চলবে না আবার ছেড়ে দিলেও হবে না। মাঝামাঝি একজন অভিভাবকের মতো থাকতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- পক্ষপাত করা যাবে না। ভাবা যাবে না এ বড় ক্রিকেটার আর ও ছোট ক্রিকেটার। কারো পক্ষ নেয়া যাবে না। কোচের পক্ষও না ক্রিকেটারদের পক্ষও না। আমাদের দেশে কিন্তু আস্তে আস্তে স্টার পাওয়ার খুব বেড়ে যাচ্ছে। সেটা বিবিসিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা এতটাই কঠিন সময় এখন যেভাবে আপনি পথচলা ঠিক করবেন আগামী ৪ বছর সেভাবেই চলবে।
প্রশ্ন: সাকিব কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা! বেশি বিশ্রাম ও ফিট থাকার কারণে? ইসাম: আমি মনে করি অন্যদের সঙ্গে তার আলাদা হওয়ার কারণ ছিল মানসিকতা। ও চিন্তা করে যে, আমি পারবো, বিশ্বাস ছিল। সেটি সে মনে প্রাণে চেষ্টা করেছে হয়েছেও। কিন্তু অন্যদের মধ্যে সেটি লক্ষ্য করা যায়নি। দেখেন কিছু কিছু ম্যাচ অন্যরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল এই ভেবে যে, আমরা পারবো না। যেমন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে এমন দেখা গেছে। সেখানে সাকিব কিন্তু নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছে। তাই ম্যাচগুলোতে কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা গেছে।
প্রশ্ন: বিশ্ব মিডিয়াতে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা বদলেছে? ইসাম: দারুণভাবে বদলেছে। এখন প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা বাংলাদেশের খোঁজ নেয়। দারুণ প্রশংসা করে। বলবো বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা আলাদা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।
NB:This post is copied from mzamin
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা