ফজলুল বারী
বাংলাদেশে কাজ করতে আসা বিদেশি কূটনীতিকরা নিজেদের অনেকটা ‘রাজা রাজা’ ভাবেন। অনেকে ঢাকা পৌঁছার আগে রাজা সাজার মহড়াও দেন! কারন বাংলাদেশের অনেক লোকজন নিজেদের ভাবেন তাদের প্রজা। এটি বাংলাদেশের এক শ্রেনীর রাজনীতিক, সরকারি কর্মচারী সাধারন মানুষ সহ অনেকেই তা ভাবেন। সাদা চামড়ার প্রতি বাংলাদেশের বিশেষ কিছু লোকজনের আলাদা একটি শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে! তাদের মদের পার্টির দাওয়াত পাওয়াকে অনেকে সৌভাগ্য ভাবেন! ভুলে যান নিজস্ব স্বাধীনতা-স্বকীয়তা। অথচ পাশের দেশ ভারতের পরিস্থিতি এর পুরো উল্টো। বিদেশি কূটনীতিকদের ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা নাক গলানো এটি কোনভাবে অনুমোদন করেনা দিল্লী। সেখানে কোন বিদেশি কূটনীতিক সে ঝুঁকিও নেননা। বাংলাদেশের অবস্থাও অবশ্য পাল্টাতে শুরু করেছে। ওয়াকিফহালরা জানেন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সহজে সাক্ষাৎ দেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি গত কয়েকজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বেলায় চলে আসছে। বাংলাদেশের অতীত বাস্তবতায় এটি একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি অর্জন করেছে।
এরকারনে বাংলাদেশের নানাকিছুতে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রভাব কমেছে। এমনও দেখা গেছে ঢাকায় আসা নতুন একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিছুদিনের মধ্যে অবস্থা বুঝতে দিল্লী যান। সাউথ ব্লকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জানার চেষ্টা করেন এখানে কতোটা নাক গলানো উচিত হবে। কিন্তু এবার দেখা গেলো ঢাকা সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে তৎপর ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন! ইশরাক-তাবিথ আউয়াল তাদের যে প্রার্থী এটা তারা বিভিন্নভাবে বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন! ভারসাম্য দেখাতে শেষের দিকে ব্যারিস্টার তাপসের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেছেন। যেখানে বেক্সিট সহ নানা ইস্যুতে ব্রিটেনের জেরবার অবস্থা, লন্ডন ব্রিজে প্রায় ছুরি হাতে ঘুরে বেড়ায় ঔদ্ধ্যত্বপূর্ন ঘাতক! আর বাংলাদেশের চিন্তায় এদের ঘুম আসেনা!
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড একে আব্দুল মোমেন অবশ্য এবার এ নিয়ে যে হুমকি দিয়েছেন তাও বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ঘটনা! পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা যদি তাদের কাজের কোড অব কন্ডাক্ট না মানেন তাহলে তাদের চলে যেতে বলা হবে! এক ধরনের বহিষ্কারের হুমকি! পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন! তার উদ্যোগে তড়িঘড়ি নয় রাষ্ট্রদূতের বিবৃতি সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে মিডিয়ায়। এতে সরকারকে এক ধরনের হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ম্যাটার করেন! কারন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা করে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দেশের চিহ্নিত সরকার বিরোধী সব মিডিয়া বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের পক্ষ নিয়েছে! এরমাধ্যমে তারা সরকারকে এক ধরনের হুমকিও দিয়েছে বলা যায়। পৃথিবীর আর কোন দেশে মিডিয়ার এমন ভূমিকা কেউ দেখবেননা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের শুরু দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই। আমেরিকা-ব্রিটেন সহ প্রভাবশালীর পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতার মুখে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মোড়লরা বাংলাদেশের এই বেয়াদবি মেনে নিতে পারেনি। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তখন উপহাসের মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশ হবে একটি বটমলেস বাস্কেট, তলাবিহীন ঝুড়ি। এরপর প্রতিশোধ নিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দেশগুলো নতুন সরকারকে নানান সহায়তা দিতে শুরু করে। মূলত এরপর থেকে আওয়ামী লীগ যে একুশ বছর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি এর পিছনে বিদেশিদেরও নানান ভূমিকা ছিল। ডক্টর কামাল যে আওয়ামী লীগ ছেড়ে আলাদা দল করেন এর পিছনেও ছিল মার্কিন প্রভাব। ইঞ্জিনীয়ারিং ইন্সটিটিউটে ডক্টর কামালের নতুন দলগঠনের অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পড়েন ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস। মূলত শেখ হাসিনার পরিশ্রমী নেতৃত্বের কারনে সেই বিদেশিদের সব ধরনের হিসাব-নিকাশ ও ধারনার বাইরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এত বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় আছে।
বাংলাদেশের বাজেট করার আগে প্রতিবছর প্যারিস কনসোর্টিয়ামের বৈঠক হতো। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সেখানে দাতাদের সামনে নানান পরকল্পনা তুলে ধরে বলতেন, ‘টেকা দেন’। সর্বশেষ বিএনপির আমলে এভাবে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান টাকা আনতে প্রতিবার বাজেটের আগে প্যারিস যেতেন। বাংলাদেশ এখন নিজের টাকায় বাজেট করে। বিদেশি সাহায্যের মুখোপেক্ষি আর নয় এই দেশ। সর্বশেষ বাংলাদেশের নিজের টাকায় পদ্মাসেতু বানানোর ঘোষনা এবং সেটি যে বাস্তবায়ন হয়ে যাচ্ছে, সেটি সাবেক দাতাদের উদ্দেশে আরেক চপেটাঘাত। বাংলাদেশে এখন আগের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের পরিবেশ-পরিস্থিতি নেই।
এর প্রতিক্রিয়ায় কী ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই রাষ্ট্রদূতদের এই তোড়জোড়? বাংলাদেশের অস্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই কিন্তু এমন কিছু তোড়জোড় দেখা যায়। আবার সরকার যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায় তখন তারা মন পাল্টায়! বাংলা সাহিত্যে এর জন্যে ঠিক করা বাক্যটি হলো ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’! দেশের কোন কিছুতেই যাতে বিদেশিরা নাক গলাতে না পারে এরজন্যে দরকার বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য।
কারন বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রদূত সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনীতির কোথাও নাক গলানোর সামর্থ্য রাখেননা। এমন কিছু করার চেষ্টা করলে তারা সঙ্গে সঙ্গে বহিষ্কার হয়ে যাবেন। বাংলাদেশের যারা বিভিন্ন দেশে আছেন তাদেরও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইন মেনে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয়। বাংলাদেশ সরকার যদি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বেআইনি তৎপরতার বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয় এরা কিন্তু আবার পচাত্তরের হত্যাকান্ডের মতো নতুন ধান্ধা করতে পারে। বাংলাদেশের লোকজনের কাছে আবেদন, ভালোমন্দ সব নিজেরা ফয়সালা করুন। স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে প্রজার মতো বিদেশিদের পিছু ছুটবেননা। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা জানি এমন কিছুর সুযোগ বিদেশে নেই। বিদেশিরা এটা পছন্দও করেনা।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা