ফজলুল বারী
দুনিয়ার দেশে দেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশিদের তালিকায় শীর্ষস্থান ভারতীয়দের। অর্থাৎ ভারতীয়রাই সারা দুনিয়ার দেশে দেশে গিয়ে সবচেয়ে বেশি নাগরিকত্ব নিয়েছে। দুনিয়াতে নিজেদের বলে বেড়িয়েছে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ। হিন্দু সংখ্যাগুরু দেশ হলেও ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে এক সময় এ তল্লাটে ভারত ছিল আলাদা মর্যাদার এক রাষ্ট্র। সে দেশ চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বের নতুন পরাশক্তি হবার কথা ছিল। এখন হঠাৎ দেশটি সবছেড়ে পরাশক্তি নয়, হিন্দু রাষ্ট্র শক্তি হতে মনোযোগী! ভালোর দিক হচ্ছে এর প্রতিবাদ হচ্ছে ভারত থেকেই। প্রতিবাদী হয়ে উঠছে ভারতের নতুন প্রজন্ম। বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বলছে, এটা ভারতের সঙ্গে মানায় না। এটি ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এসব শুনতে নারাজ ভারতের চলতি ধর্মান্ধ শাসকেরা। যেখানে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল নিজের পরিচয় পাল্টেছে, ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের হঠাৎ মনে হয়েছে তাদের যে হিন্দু হওয়া চাই! এটি ভারতের বিপদজ্জনক এক খেলা! এ খেলা যদি সফল হয় এর প্রভাব পড়তে পারে সবার আগে বাংলাদেশে! প্রতিবেশী হিন্দু রাষ্ট্রের মোকাবেলায় বাংলাদেশে বাড়তে পারে রাষ্ট্রীয় মুসলমানিত্বের কুক্কুরুক্কু! এই ভারতকে ঠেকাতে হবে। অথচ এই ভারত নিয়ে বিদেশে আমাদের বাংলাদেশেদেরও নানান অবস্থায় পড়তে হয়। একবার মিশরে গেলাম রিপোর্ট করতে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে সেখানে যেতে টেক্সি নিতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ টেক্সিচালক বাংলাদেশ দেশটি কোথায় তা জানেনা। বলতে হয় গাম্বল হিন্দ। অর্থাৎ হিন্দ তথা ভারতের পাশে। কায়রোর সিনেমাহলগুলোতে তখন মুম্বাইর ছবি মুক্তি পেতো নিয়মিত। ডিস্কো ড্যান্সার’ ছবির জন্য মিঠুন চক্রবর্তী হয়েছিলেন বিশেষ জনপ্রিয়। আমাদের বিপদ বিদেশে অনেক সময় আমাদের দেখে লোকজন ভারতীয় ভেবে বসে। তেমনি মিশরেও অনেকে ভারতীয় ভেবে পথেঘাটে দেখা হলেই গেয়ে উঠতো, আই এ্যাম এ্যা ডিস্কো ড্যান্সার। এমন পৃথিবীর যত দেশে গেছি সবজায়গাতেই ভারতীয় দাপট। লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে নামার সময় নীচে দেখি হাঁটছেন মাথায় টারবান বাঁধা শিখ বিমান বন্দর কর্মী। মানে ভারতীয়। মরিশাস একটা দেশে গেলাম সেটিও ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের একটি দেশ। টাকার নামও রূপি। সেই দেশ যে ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর সব দেশের মাঝে সে এখন খুঁজছে তার দেশে কে ঢুকেছে! অথচ এই ভারতটার প্রতি আমাদের কত কৃতজ্ঞতা। যখন আমাদের দেশ ছিলোনা ভারতমাতা আমাদের উজাড় করে সব দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি শরণার্থী গিয়ে আশ্রয় নিলো ভারতে। তখন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা আজকের মতো ভালো ছিলোনা। আমেরিকা-ইউরোপ-চীন-সৌদি আরবসহ বিশ্ব ছিলোনা বাংলাদেশের পক্ষে। তাই এত শরণার্থীর বোঝা টানতে ভারতের হিমশিম অবস্থা। তখন ভারতের নাগরিকদের ওপর বসানো হলো শরণার্থী ট্যাক্স। বাসে-ট্রেনে-ট্রামে চড়লে, নানান কেনাকাটায়, এমনকি সিনেমার টিকেট কিনতে গেলেও দিতে হতো শরণার্থী ট্যাক্স। শুধু তাই না, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন-অস্ত্র দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের যুদ্ধে তাদের ১১ হাজার সৈন্য মারা গেছেন। এমন কত যে স্মরণীয় সব অবদান। কিন্তু যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে গেলো ভারত যেনো বাংলাদেশকে দেখলো পাকিস্তানের মতো আরেকটি দেশ! ফারাক্কায় আটকে দিলো গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ। এখনও তিস্তায় আটকা ভ্রাতৃপ্রতীমের ভালোবাসা! ভারত যেনো এখন শুধু নিতে চায়। বড়র মনটা বড় মহৎ হৃদয় হতে হয়। কিন্তু এই ভারতের বড় হৃদয়ের নয়। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের মনের মধ্যে যে বাংলাদেশ তা বোঝা সহজ। বাংলাদেশ থেকে নির্যাতিত হিন্দুরা ভারতে গেছেন এটা সত্য। গরিব মুসলমান গেছেন এটাও সত্য। যখন একটাই দেশ ছিল ভারতবর্ষ তখন থেকে এলাকায় এলাকায় মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি। যশোরের একটা অংশে যে ফুল চাষের বিপ্লব ঘটে গেছে সেটিওতো সেই সম্প্রীতির কারনে। দেশ ভাগ-সীমানা ভাগ আছে। কিন্তু হৃদয়তো ভাগ হয়নি। জমির আইলের এক পাশ বাংলাদেশ, আরেক পাশ ভারত। ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে দুই দেশের দুই কৃষক প্রতিদিনইতো চাষবাস নিয়ে পরষ্পরের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে। শার্শার শালকোনার এক সীমান্ত ডিঙ্গানো মানুষ নিয়ে একবার রিপোর্ট করেছিলাম। সরল ওই মানুষটির রক্তের অভ্যাসটি ছিল প্রতিদিন একবার করে হলেও সীমান্তের ওপারের হাটের চায়ের দোকানে চা খেতে আড্ডা দিতে যাওয়া। অথচ এপাশে হাট-চায়ের দোকান সব আছে। দু’পাশের মানুষগুলো দেখতে এক রকম, ভাষাও এক। দেশ-সীমান্ত দিয়ে তার হৃদয় ভাগ করবেন কী দিয়ে? যার কথা লিখেছি সেই সরল গ্রামবাসীতো স্থায়ীভাবে ভারতে চলে যায়নি। যাবেওনা। কিন্তু এক সময় বিস্তর লোক সুবিধামতো এপার ওপার করেছে এটাতো সত্য। খাগড়াছড়িতে যেমন আসাম বস্তি আছে আসামেও তেমন আছে নোয়াখালী বস্তি। খোঁজ নিয়ে দেখুন দুই বস্তিতেই ঠাঁই নিয়েছিল দুই দেশের গরিব মানুষেরা। এখন গরিব হিন্দুদের আশ্রয় দেবেন আর মুসলমানদের দেশহীন করবেন এটাই কি ভারতমাতার কৌলিন্য? এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কী সুপার পাওয়ার হওয়া যাবে? আশার কথা ভারতের নতুন প্রজন্ম রাষ্ট্রের এই বিভাজন নীতির প্রতিবাদ করেছে। অবিস্মরনীয় এক ছাত্র আন্দোলনও গড়ে উঠেছে ভারতে। এই প্রজন্ম বলছে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী। দেশটায় অনেক গরিব মুসলমান আছেন যাদের জন্ম ভারতে, কিন্তু কোনদিন নাগরিকত্বের কাগজপত্রই সংগ্রহ করেননি। এক আইন বলে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া যাবেনা। এর আগে বিশ্ব ভারত থেকে এ রকম ছাত্র আন্দোলন দেখেনি। এখন দেখছে। ভারতের এই প্রতিবাদ আবার ভিন্ন রাজ্যে ভিন্নরূপে ছড়িয়েছে। আসামের এনআরসিতে পাওয়া গিয়েছিল নাগরিকত্বহীন হিন্দুর সংখ্যা বেশি। মূলত তাদের নাগরিকত্ব দিতে নতুন নাগরিক আইনটি করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে আসাম থেকে বলা হচ্ছে তারা তাদের রাজ্যে এই আইন চায় না। এই আইনের মাধ্যমে নতুন কাউকে নাগরিকত্ব দেয়া হোক এটি চায় না আসাম। আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতার কারন এটি করতে গেলে তা হানা দেবে তৃণমূলের ভোটব্যাংকে। এমন ভিন্ন ভিন্ন মতে পুরো বিষয়টি নিয়ে ভারতের জনমতের বিভক্তি স্পষ্ট। মমতা ব্যানার্জী এ নিয়ে বাংলায়(তাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের নতুন নাম ‘বাংলা’) নতুন মুক্তিযুদ্ধেরও হুমকি দিয়েছেন! মমতা বন্দে মাতরম বলেন, আবার জয়বাংলাও বলেন। মোটকথা একসময় ভারতীয়দের ঐক্য ছিল ঈর্ষনীয়। সেই ভারতে আজ অনৈক্যের পদধবনি। আগে ভারতে একটি কাশ্মীর সমস্যা ছিল। এখন অনেক কাশ্মীর ভারতে। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের অধিকার চিহ্নিত করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে ভারতের ঐক্যকে দূর্বল করছে এটা তারা যত দ্রুত বুঝতে পারবে তত ভারতের জন্যে ভালো। নইলে এমন অনৈক্যের ধর্মীয় রাষ্ট্র সুপার পাওয়ার হতে পারবেনা। এটি বিদেশেও ভারতীয়দের দাপটকে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট করবে।
# লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
fazlulbari2014@gmail.com
লাল সবুজের কথা’র ফেসবুক পেজ।
আরও পড়ুন : আমি স্বাধীন দেশ ও পতাকা দিতে পেরেছি কিন্তু গণমানুষের মুক্তি আসেনি : আবুল বাশার
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা