আবদুর রহমান মল্লিক
মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবের অর্জন। এ বিজয় রক্ত দিয়ে কেনা। লক্ষ শহীদ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আজ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। মতাদর্শ আর রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করলেও আমরা যে এগিয়ে চলছি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সারাদেশের দিকে তাকালে বুঝতে পারি আমাদের জীবন মানের উন্নয়ন হয়েছে। এ উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার মূল নিয়ামক দেশের শ্রমিক ও মেহনতি জনগন। বিজয়ের এই মাসে এই নিঃস্বার্থ মানুষগুলোকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রাম, কারাবাস ও জীবনবাজি রাখা প্রজ্ঞাময় নেতৃত্বের জন্য একাত্তরে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি স্বার্থকভাবে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে দ্রোহের উচ্চারণ করেছিলেন,লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে চুড়ান্তভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, দেশের সাতকোটি মানুষের ধমনীতে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশবাসিকে প্রস্তুত করার জন্য তা ছিল যথেষ্ট। তার গ্রেফতার বরণ করার ঘটনা মুক্তিসংগ্রামকে করেছিল আরো বেগবান। বিনিময়ে পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হল। আমরা পেলাম স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন মানচিত্র।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ার জন্য সম্মীলিত প্রচেষ্টার পরিবর্তে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র, বিভক্তি। সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার স্থপতিকেই সপরিবারে হত্যার শিকার হতে হয়। জাতীর জন্য এটি যে কত বেদনার তা ব্যাখ্যা করার কোনো ভাষা নেই। শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি জেলহত্যার মতো নারকীয় ঘটনাও সংঘটিত হলো। একইভাবে একুশে আগষ্ট গ্রেনেড হত্যা, পিলখানা হত্যাকান্ড আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে।
কলামিস্ট যতীন সরকার তার নিবন্ধে যথার্থই বলেছেন,‘আমরা বিজয় অর্জন করেছি এখন আমাদের মুক্তি অর্জন করতে হবে।’ কারণ আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি ও সামাজিক অসঙ্গতি। রাতারাতি অনেকে বনে যাচ্ছে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক। পত্রিকান্তরে দুর্ণীতির ভয়াবহ চিত্র আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই। অব্যবস্থাপনার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘটে যায় এসব দুর্ণীতি। দুর্ণীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের জাতীয় অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। আমরা তাই তাকিয়ে আছি দুর্ণীতি রিরোধী শুদ্ধি অভিযানের দিকে। আমরা আশাবাদী হতে চাই এই অভিযান এক দিন সফল হবে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হয়। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাকিস্তানী স্বৈরশাসক সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেও সে নির্বাচনকে তারা মেনে নেয়নি। উপরন্ত এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে এদেশের নিরীহ জনসাধারণের ওপর। গণতন্ত্রকে দলিত মথিত করে তারা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। তাই কোনো নির্বাচন যেন বিতর্কিত না হয়। সেটি আমাদের স্বাধীনতার চেতনার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় আমাদের এই দেশে ধর্ষনের ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটে চলেছে। একের পর এক শিশু ও নারী ধর্ষনের ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। ধর্ষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। ধর্ষক যেন কিছুতেই পার না পায়। তাদের শান্তি হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। অপরাধের শাস্তি প্রসঙ্গে একজন দার্শনিক বলেছেন, ণড়ঁ হড়ঃ ঢ়ঁহরংযবফ ভড়ৎ ংঃড়ষবহ ংযববঢ়. ণড়ঁ ধৎব ঢ়ঁহরংযবফ ভড়ৎ ধ ংযববঢ় সঁংঃ হড়ঃ নব ংঃড়ষবহ. অর্থাৎ ভেড়া চুরির জন্য তোমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, ভেড়া যাতে আর চুরি না হয় সেজন্য তোমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কাজেই সেই শাস্তি দিতে হবে যাতে ধর্ষকের কলিজার কাঁপন ধরে যায়। কেউ যেন আর ধর্ষণ করতে উদ্ধত না হয়।
ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ,স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। যে ছাত্র সমাজ দেশের মুক্তি এনে দিয়েছিল সেই ছাত্র সমাজে যেন হতাশাগ্রস্থ না হয়ে পড়ে। তাদের মাঝে আশার আলো জ্বালাতে হবে। তার যেন শুধু শিক্ষা নয় সুশিক্ষিত হতে পারে। তারা যেন হতে পারে দায়িত্ববান নাগরিক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন চলে শুধু লেখাপড়া আর সৃজনশীল কর্মকা-ের প্রতিযোগিতা। নতুন প্রজন্ম যে দেশ নিয়ে ভাবে তা আমরা লক্ষ করেছি, যখন তারা সড়কের শৃঙ্খলায় রাস্তায় নেমে এসেছে। রাস্তার শৃঙ্খলার জন্য কোমলমতি শিশুরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা নজীরবিহীন। দেশটি যে অজুত সম্ভাবনার সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এর নাগরিকদের প্রত্যাশাও অনেক বড়। দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চায় সকল নাগরিক। কে না চায় দেশের জন্য কিছু একটা করতে। দেশের ছাত্র জনতাকে সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। দেশটি আমাদের সকলের, তাই সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ শক্তি পরিণত করতে হবে। সমাজ থেকে বিভেদ বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে। আমাদের জাতীয় নেতাদের প্রতিটি বক্তৃতা ভাষণ হতে হবে জাতিগঠনমূলক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমরা উজ্জীবিত হই । বার বার সেই ভাষণ শুনতে পছন্দ করি। কারণ এমন ভাষণ আর হয় না। কিন্তু আমরা অনেকই খেয়াল করিনা তাঁর ভাষণে কোনো ব্যক্তি বিদ্বেষ নেই। কারণ তিনি সকল নাগরিককে নিজের করে ভাবতেন। তাঁর হৃদয়টা ছিল অনেক বেশি প্রশস্ত।
ভালোবাসা হচ্ছে মানুষের বড় শক্তি। ভালাবাসা দিয়ে যা অর্জন করা যায় অন্যকিছুতে সেটি সম্ভব নয়। যিনি ভালাবাসতে জানবেন তিনি ঘৃণা করতে জানবেন না। মহামানবদের মাঝে আমরা সেই মহৎ গুণটিই লক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, পশ্চাতে টানিছো যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে। তাই সবাইকে সাথে নিয়ে চলবো, কাউকে পশ্চাতে ফেলবো। প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। বিজয়ের এই মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, দৈনিক যায়যায়দিন।
Email.mallickmnj@gmail.com
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা