অনলাইন ডেস্ক
যার কারণে আমরা পেয়েছি কাজী জহির, জহির রায়হান, খান আতা, সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, কাজী হায়াৎ, মতিউর রহমান, আব্দুল আল মামুন, এহতেশাম, কামাল আহমেদ, মুস্তাফিজের মত অসংখ্য মেধাসম্পন্ন পরিচালক। তেমনি পেয়েছি সুমিতা দেবী, শবনম, সুজাতা, শাবানা,ববিতা, সুচরিতা, রোজিনা, চম্পা, দিতি এবং অঞ্জু ঘোষের মতো জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী।
এই শিল্পীদের মধ্যে বেশকিছু অভিনেত্রী ছিলেন ভীষণ রকমের প্রতিভাবান। তারাও অসংখ্য জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন তাদের অভিনয়গুণ দিয়ে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়েছে তাদের এ প্রতিভাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার মতো কোনো চরিত্র তাদের দেয়া হয়নি তাদের সময়ে অথবা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারেনি এই ভেবে যে তারা সেটা সেভাবে ধারন করতে পারবেনা।
ছবির পরিচালকে বলা হয় “ক্যাপটেন অফ দা শিপ”। একটা চলচ্চিত্রে গল্প থাকে। সেই গল্পে থাকে বিভিন্ন চরিত্র। সেই চরিত্রে কে কোথায় অভিনয় করবে তা ঠিক করে একমাত্র পরিচালক। তো এইভাবে পরিচালকরা নায়িকাদের চরিত্রের নির্ধারণ করেন বা তাদেরকে ঘিরে গল্প লিখেন।
সেইসব চারজন অভিনেত্রীর কথা আজ আমি বলব যাদের মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি অথবা তারা সেই সুযোগ পায়নি। হয়তো পরিচালকরা ভেবেছিল তারা কমার্শিয়াল চরিত্রে অভিনয় করে, আর্ট ফিল্ম বা কালজয়ী চলচ্চিত্রের চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক হবে না। সেই চারজন শিল্পী হলেন যাদের মেধার মূল্যায়ন করা হয়নি তারা হলেন সুচরিতা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ এবং জুলিয়া।
সোনা যেমন পুড়ে পুড়ে খাটি হয় তেমনি আমার মনে হয় এই চার অভিনয়শিল্পীকে যদি জয়গুন, নবীতুন গোলাপি, জরিনা, সখিনার মত চরিত্রে দেয়া হতো তাহলে হতো তারা চলচ্চিত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করতো। তাদের মেধারও অপচয় হতো না। প্রথমে অসম্ভব মেধাবী অভিনয় শিল্পী সুচরিতার কথা বলব।
সুচরিতা: শিশুশিল্পী হিসেবে বেবি হেলেন নামে বিখ্যাত পরিচালক মোস্তাফিজের হাত ধরে খুব সম্ভবত প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন এই অভিনেত্রী। ছবির নাম ছিল ‘বিজলি’। তার চরিত্রের নাম ছিল বাবলু। ছবিতে তিনি বাংলার কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার ছোট ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এরপর পূর্ণাঙ্গ নায়িকা হিসেবে অনেক জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন। মোটামুটি সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু তার ‘ যাদুর বাঁশি’, ‘দোস্ত দুশমন’ এবং ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ এবং দাঙ্গা ছাড়া এই প্রায় পাঁচ দশক অভিনয় জীবনে আর কোন কালজয়ী চরিত্রে অভিনয় করতে পারেননি। তার ঝুলিতে মাত্র একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কি মেধার অবমূল্যায়ন। যারা তার ‘দোস্ত দুশমন’ ছবি দেখেছেন আমার ধারণা ওই ছবিতে জনপ্রিয় নায়িকা শাবানা থাকা সত্ত্বেও দর্শকদের নজর তার দিকেই ছিল।
রোজিনা: অসম্ভব জনপ্রিয়, গুণী এবং পরিশ্রমী এই অভিনেত্রী তার নিজের যোগ্যতায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। পুরো আশির দশকে দাপটের সহিত অভিনয় করেছেন। এমনকি তখন বলা হতো একমাত্র শাবানার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ছিলেন তাই। শাবানার জনপ্রিয়তায় বসিয়েছিলেন ভাগ এই অভিনয়শিল্পী। এমন কোন চরিত্র নেই যেখানে তিনি অভিনয় করেননি। অথচ কেনো যেনো আমার মনে হয়েছে গ্রামীণ চরিত্রে তিনি ছিলেন অসাধারণ । কবরীর পর সেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘কসাই’ ছবিতে। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। শিল্পীদের সুন্দর সুন্দর চরিত্রের প্রতি একটা ক্ষুধা থাকে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তিনি সেদিকে নজর না দিয়ে বাণিজ্যিক ছবির প্রতি বেশি ঝুঁকে ছিলেন। অথচ নিজের প্রোডাকশন অফিস ছিল। নিজেই হতে পারতেন কালজয়ী চরিত্রের অভিনেত্রী। যেমন আমরা তাকে দেখেছি আর একটি চলচ্চিত্রে তার নাম ‘সুরুজ মিয়া’তে।
অঞ্জু ঘোষ: পরিচালক এফ কবীর চৌধুরীর আবিষ্কার অঞ্জু ঘোষ পুরোপুরি কমার্শিয়াল ছবির মাধ্যমে আবির্ভূত হন আশির শুরুর দিকে। তিনি অসংখ্য ছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তাতে আর্থিকভাবে হয়তো তিনি লাভবান হয়েছেন, বঞ্চিত করেছেন দর্শকদের। নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে চাননি বা দেননি অথচ তার ছিল মঞ্চে অভিনয় করার বিশাল অভিজ্ঞতা। কেন জানি তিনি নিজেকে রহস্যময় করে রাখতে ভালোবাসতেন। তিনি রোজিনার মত কমার্শিয়াল, ফ্যান্টাসি ছবিতে ব্যস্ত থাকতেন। হয়তো এই কারণে ভালো পরিচালকেরা তাকে দিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জিং চরিত্র করাতে চাইছেন না। তার মেধার পরিচয় পাওয়া গেছে ‘ছলনা’ নামক একটি ছবিতে। তিনি যে পারেন সেটা তো প্রমাণ করে দিয়েছেন ওই ছবি কিংবা ‘যন্ত্রণা’ বা ‘দায়ী কে’? ছবিতে।
জুলিয়া: মাসুদ পারভেজ ওরফে বাংলা চলচ্চিত্রের ড্যাসিং হিরো সোহেল রানার আবিষ্কারক হলেন এই অভিনেত্রী জুলিয়া। তিনি বর্তমানে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। অসম্ভব প্রতিভাবান এ অভিনেত্রী তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘জবাব’ এর মাধ্যমে তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এরপর ‘খোকন সোনা’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’ ‘দিলদার আলী’ তে সেটা আরো প্রমাণ করে দিয়েছেন। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হয় কোন পরিচালক তাকে নিতে চাননি একক অভিনয়শিল্পী হিসেবে। একমাত্র প্রতিভাবান এ অভিনেত্রীর অবমূল্যায়ন করা হলো তার অভিনয়ের এবং চলে গেল একটি প্রতিভা। তাকে সব সময় দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। এরপর এলো নব্বই দশক। এক ঝাঁক অভিনয়শিল্পী পুরো চলচ্চিত্র শিল্পকে দাপিয়ে বেড়ালো এক দশক। দর্শক এদেরকে সাদরে আহবান জানাল। এদের মধ্যে সে আগের দশকের মত অনেক প্রতিভাবান অভিনেত্রী এসেছিলেন। যেমন শাবনাজ, মৌসুমী, শাবনূর, পপি ও পূর্ণিমা। কিন্তু এদের প্রতিভার মূল্যায়ন করার জন্য তেমন ছবি, পরিচালক বা চরিত্রের ছিলনা সেসময়। কেউ এগিয়ে আসেনি তাদের জন্য। কেউ ‘সারেং বউ’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ বা ‘ভাত দে’ মত ছবি করার আগ্রহী হয়নি। তারা হতে আমাদের পরবর্তী ববিতা কবরী বা শাবানা। তখনো পরিচালকরা বেঁচে ছিলেন তারাও এসব অভিনেত্রীদের জন্য তৈরি করেননি কালজয়ী চরিত্র। বিশেষ করে আমি বলবো শাবনূর ও পূর্ণিমার জন্য এবং তাদের মেধার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
মৌসুমী এবং পপির জন্য যেমন পরিচালক নার্গিস আক্তার এগিয়ে এসেছিলেন তেমনি উপরোক্ত তিনজনের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। অথচ ‘নির্মম’ দিয়ে শাবনাজ, যেখানে শাবানার সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন, ‘দুই নয়নের আলো’ দিয়ে অসম্ভব মেধাবী অভিনেত্রী শাবনূর এবং চাষী নজরুল ইসলাম এর ‘শাস্তি’ ছবি দিয়ে পূর্ণিমা তার প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন যে তারা তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর ঘটাতে পারেন যদি তাদের সুযোগ দেয়া হয় প্রতিভা বিকাশের। এ প্রসঙ্গে আমি বলব পূর্ণিমা চম্পাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন ‘শাস্তি’ ছবিতে। অথচ মূল্যায়ন হলো না তার, পুরস্কার পেলেন চম্পা।এই ভাবেই কালেরগর্ভে হারিয়ে যায় এসব প্রতিভাবান অভিনেত্রীরা। এরা অসংখ্য হিট ছবি উপহার দিয়েছেন, আজীবন মনে রাখার মত চরিত্র তারা পেলেন না এটাই আফসোস। প্রথম প্রজন্মের চারজন সুযোগ পেল না ভালো ভালো প্রতিভাবান পরিচালক থাকা সত্ত্বেও আর দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীরা সুযোগ পেলেন না প্রতিভা বিকাশের। কারণ তখন এইসব পরিচালকরা পরিচালনা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের দূরে থাকার কারণে এই অভিনেত্রীরা বঞ্চিত হলেন তাদের প্রতিভা বিকাশের। অভিনয়শিল্পীদের এটা বোধহয় সারা জীবন থেকে যাবে আর দর্শকরা বঞ্চিত হবেন, কষ্ট পাবেন মেধাবীদের মেধার অবমূল্যায়ন দেখে।
আবু মোহাম্মদ মাছানী, সিনিয়র সাংবাদিক, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা