ফজলুল বারী : জয় বাংলা শ্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান ঘোষনা করে হাইকোর্ট একটি রায় দিয়েছে। হাইকোর্টের এই রায়ের বেশকিছু অস্পষ্ট দিক আছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে এ লেখায় আলোচনা করবো। আইনমন্ত্রী অথবা এটর্নি জেনারেলের অফিস এ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যার ব্যবস্থা করতে পারেন। মঙ্গলবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের রায়ের আদেশে বলা হয় ‘আমরা ঘোষনা করছি যে জয় বাংলা বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান হবে। জাতীয় দিবসগুলোয় উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সব কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান যাতে উচ্চারন করেন, সে জন্যে বিবাদীরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করবেন। আদেশে আরও বলা হয় , সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যাসেম্বলি শেষে ছাত্র শিক্ষকেরা যাতে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান উচ্চারন করেন, সে জন্যে বিবাদীরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন’।
এসব নির্দেশেনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের কাছে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডক্টর বশির আহমেদের করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে মঙ্গলবার ওই রায় দেয়া হয়। রায়ের ‘বিবাদী’ বলা হয়েছে সরকারপক্ষকে।
জয় বাংলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকে একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় ছাত্র-শ্রমিক-গণজমায়েতগুলোতে এই শ্লোগান তখন জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি করেছিল। সাত মার্চের ভাষন বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা’ শ্লোগানের মাধ্যমে শুরু করেন। স্বাধীনতার ঘোষনাতেও এই শ্লোগানটি ছিল। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথের পর শ্লোগান দেয় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ সহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় শ্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা কোন অপারেশনে রওয়ানার আগে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরুতেন। অপারেশন শেষের বিজয় ধবনিও ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। এভাবে বিজয়ী বাংলাদেশের শ্লোগান হয় জয় বাংলা।
কিন্তু স্বাধীনতার পর জাসদ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জয় বাংলা শ্লোগানটি পরিহার করতে শুরু করে! অথচ জাসদের উদ্যোক্তা নেতারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। ভারতের ‘জয় হিন্দ’ শ্লোগানের সঙ্গে জড়িয়ে তখন গ্রামেগঞ্জে একদল ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ’ এমন কৌতুক শ্লোগান প্রচলিত করা শুরু করে তখনই।
পচাত্তরের পনের আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর হত্যাকারীরা রেডিওতে ঘোষনা দেবার সময় থেকে জয় বাংলা’র বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্টাইলে বলা শুরু করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ বেতারের নাম পাল্টে রেডিও পাকিস্তান স্টাইলে রাতারাতি করা হয় রেডিও বাংলাদেশ! মূলত জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান চালুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রাজনৈতিক চরিত্রের প্রকাশ পায়। এরপর দুই সামরিক জেনারেল জিয়া-এরশাদ তাদের রাজনৈতিক দল বিএনপি-জাতীয় পার্টির শ্লোগান করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এভাবে তারা পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা শ্লোগান। সরকারি প্রচার মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয় বঙ্গবন্ধু এবং জয় বাংলা শ্লোগান। এভাবে জিয়া-এরশাদের একুশ বছরের দাপটের শাসনের সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম জানতে শেখে জয় বাংলা আসলে আওয়ামী লীগের শ্লোগান!
ক্ষমতাচ্যুতির একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আবার জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানের সঙ্গে প্রচার শুরু হয় ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’। ২০০১’এ বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরলে জাতীয় অনুষ্ঠান জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আবার নির্বাসিত ‘জয় বাংলা’। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর জয় বাংলা’ আবার ফিরেছে। এরমাঝে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে প্রতিবাদী প্রজন্মের বিপুল উচ্চারনের গর্জনও শুনেছে বাংলাদেশ। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ক্ষমতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান জয় বাংলা যেহেতু নির্বাসিত হয় সে জন্যে প্রশ্নও আসে হাইকোর্টের রায়ের ভবিষ্যত কী?
কারন উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়ন নিয়ে আগের কিছু উদাহরন আছে। এর আগে উচ্চ আদালতে শাসনতন্ত্রের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বেআইনি ঘোষনা করা হয়। এই দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয় জিয়া-এরশাদের শাসনামলের। সংশোধনী দুটি বেআইনি ঘোষনার মাধ্যমে বিএনপি-জাতীয় পার্টি দল দুটির বৈধতাও প্রশ্নের মুখে পড়ে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো উচ্চ আদালতের রায়ের ফলোআপ বা তা বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বা সে চেষ্টাও করা হয়নি। এরশাদ আমলে সপ্তম সংশোধনীর আংশিক তথা হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় শহরগুলোতে নেবার বিধান বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। কিছু তখনও সপ্তম সংশোধনীর রাষ্ট্রধর্ম অংশে হাত দেয়া হয়নি।
জয় বাংলা’র রায়ে শুধু জাতীয় তথা সরকারি অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এরমানে কী দাঁড়ায় যারা জয় বাংলা শ্লোগান দেয়না, বিএনপি-জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো যারা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে তাদের জয় বাংলা’ বলা বাধ্যতামূলক নয়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এসেম্বলির পর জয় বাংলা’ শ্লোগান বাধ্যতামূলকভাবে দেয়া হয় কীনা তা মনটরিং’এর নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় মাদ্রাসাও আছে। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীতই গাওয়া হয়না। অনেকে এটিকে একজন হিন্দু কবির লেখা গান মনে করে! মাদ্রাসায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় কীনা তা দেখেও না দেখার ভান করে সরকারি কর্তৃপক্ষ! সেখানে এসেম্বলিতে জয় বাংলা’ বলা হবে? হাইকোর্টের আদেশের বাধ্যতামূলক দিকটির ব্যাখ্যা কে দেবেন? আইনমন্ত্রী না এটর্নি জেনারেলের অফিস?
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা