বাসস
প্রসঙ্গটির অবতারণা এই কারণে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আর একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখক কবি সাহিত্যিকদের অফুরন্ত ক্লান্তিহীন বিভিন্ন রচনা প্রমাণ করে শতাব্দীর এই মহানায়কের কোন রচনা নয়, তিনি নিজেই গবেষকদের দুশ’ বছরের গবেষণার বিষয়বস্তু।
কথাটি যে খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয় তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার নিবন্ধ, গবেষকদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ, কবিদের কবিতা অথবা কোন না কোন নাট্যকারের চিত্রকল্প। পৃথিবীতে হাতেগোণা কয়েকজন রাষ্ট্রনায়ক যারা সেসব দেশের কবি, সাহিত্যিক লেখকদের লেখা বিষয়বস্তুতে এবং সে সব রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তাধারাকে ধারণ করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের বঙ্গবন্ধু তাদের মধ্যে একজন হতে পেরেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রনায়ক, মেহনতী মানুষের মুক্তিদাতা মহামতি লেলিন সে দেশের লেখক বুদ্ধিজীবী, কবিদের খুব বেশি প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।
লেলিন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলেন না, পৃথিবীর সব দেশের মুক্তি সংগ্রামে সকল মুক্তিকামী প্রতীকে পরিণত হতে পেরেছিলেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরতায় ছিল লেলিন এবং তার বিপ্লব। আসলে একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধশালী করতে রাজনৈতিক ঘটনা, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং বীরত্ব গাঁথার গুরুত্ব অপরিসীম।
সেদিক থেকে আমাদের সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য দুটোরই অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের এই ভূখন্ডে ভাষার জন্য আন্দোলনের একটি প্রেক্ষাপট পেয়েছিলাম। আমাদের দেশে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখকরা ভাষা আন্দোলন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তাদের রচনাকে সমৃদ্ধশালী করেছিলেন।
দ্বিধা ছাড়াই বলা যায়, আমাদের শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, কবিতা, চলচ্চিত্রে যারাই আজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা অনেকেই ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনকে ধারণ করেই তাদের বিকাশ। এই জন্য বোধ হয় আমাদের ষাট দশকের সাহিত্য কর্ম এখনও একটি বিশেষ অবস্থানে চিহ্নিত হয়ে আছে।
একইভাবে ঊনসত্তরের আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবী এবং কবি-সাহিত্যিকদের। বলা যায়, আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধটাই একটি বিশেষ মহাকাব্য।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে আমাদের শিল্পের শাখাসমূহ যখন বিকশিত হতে থাকে তখনই ঘটে ইতিহাসের মর্মন্তুদ ঘটনাটি। আর এ জায়গায় এসেই দুর্ভাগ্য যোগ হয় বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। সমৃদ্ধশালী একটি দেশ ও জাতির বীরত্বগাঁথা নিয়ে ইতিহাস রচিত হয়, যুগে যুগে লেখক, শিল্পীরা সেই ইতিহাস থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে সেই দেশের শিল্প ভান্ডারকে সমৃদ্ধশালী করতে থাকেন।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের যে বীর গাঁথার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তীতে সেই বীর গাঁথার ‘নায়ক’ হঠাৎ করে অস্পৃশ্য হয়ে যান। অস্পৃশ্য ঠিক নয় তাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সুগভীর চক্রান্ত শুরু হয়। বস্তুত বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ রাজনৈতিক বিপর্যয় ও সাংস্কৃতিক অপঘাত। এ হত্যাকান্ড গণসংস্কৃতির বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
এ নিয়ে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সদ্যপ্রয়াত কামাল লোহানী জীবদ্দশায় বলেছিলেন , বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দেশের সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিনের জন্য। তখন যেমন এ নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ রাজনৈতিকভাবে হয়নি, তেমনি সাংস্কৃতিক কর্মীরাও কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পরে গণসংস্কৃতির বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের পরে সামরিক শাসন জারি ও যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়ে-মোটকথা পুরো দেশের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল।’ ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সাবেক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ নির্মম হত্যাকান্ডের পরে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও পিছিয়ে পড়ে পুরো বাঙালি জাতি। বাঙালিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। ১৯৭৫ সালে ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে যখন নাট্যচক্রের প্রযোজনায় সালেক খান রচিত ‘প্রত্যাবর্তনের দেশে’ নাটকটি মঞ্চায়ন করতে যান, তখন সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হন। তখন টিএসসিতে অনুষ্ঠান করতে পারতেন না। স্বাধীনতা উত্তর নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা নাসির উদ্দিন ইউসুফের মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে সেনা শাসনের কারণে সংস্কৃতি চর্চা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মঞ্চ নাটক, যাত্রাসহ অন্যান্য মাধ্যমে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। বেতার ও টেলিভিশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বলা যেতো না। ‘জয়বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ চালু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড একদিকে রাজনৈতিক বিপর্যয় অন্যদিকে সাংস্কৃতিক অপঘাত মন্তব্য করে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ভাষার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল সেটিতে আঘাত করা হয় নারকীয় এ হত্যাকান্ডের পরে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির যে বিজয় শুরু হয়েছিল সেটা ১৯৭৫ সালে এসে তীব্রভাবে ধাক্কা খায়।’ এ কারণেই ’৭৫-পরবর্তীতে আমাদের শিল্প সংস্কৃতি যতটুকু পুষ্ট হওয়ার কথা ছিল ততটুকু হতে পারেনি। তবে এ ক’বছরে ছিটেফোটা যে কিছু হয়নি তা কিন্তু ঠিক নয়। বীর গাঁথার নায়ক হয়তো সরাসরিভাবে অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে যে তাকে নিয়ে শোক গাঁথা যেমন রচিত হয়েছে তেমনি করে তার বিজয় গাঁথাও বহু লেখক-শিল্পীও রচনা করেছেন। আমাদের বীর গাঁথা আছে, বীরত্বও আছে। কিন্তু সেই বীর গাঁথার নায়ক ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম উচ্চারণ এবং তাকে নিয়ে লেখালেখি ছিল রীতিমত নিষিদ্ধ। অথচ মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হচ্ছে সমার্থক শব্দ। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলে আমাদের কোন শিল্প কর্মের পূর্ণতা আসে না। বস্তুত ’৯৬-এর ১২ জুনের নির্বাচনের পর আমাদের ইতিহাসের উৎস আবার নতুন করে উন্মোচিত হয়ে পড়লেও ২০০১ সালের নির্বাচনে আবারো পঁচাত্তর পরবর্তী বাঙালি সংস্কৃতি বিনাশী শক্তি সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বিপন্ন করে তোলে আমাদের শিল্প সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল পুনরায় সরকার গঠন করলে আমাদের লেখক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকরা আবার ফিরে পায় ইতিহাসের মূলধারা। শাণিত করছেন তাদের লেখনীকে। আর অনিবার্যভাবে এসব লেখনীতে উঠে আসছে বঙ্গবন্ধুর অনেক না জানা কথা। ক্রমাগত বিশ্লেষিত হচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন লেখায় উঠে আসছে তার নানাদিক। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে তাদের লেখনীর মধ্য দিয়ে নতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। লেখক বুদ্ধিজীবীরা ক্লান্তিহীনভাবে লিখে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। প্রতিদিন আবিষ্কার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নানাদিক। স্বীকার করছি উৎসের সন্ধানে অনেক লেখক এখনও দারুণ আবেগে ভুগছেন কিন্তু এটাতো ঠিক লেনিন রবীন্দ্রনাথের মত বঙ্গবন্ধুও এখন একটি বিষয়। যাকে ক্রমাগত ব্যবচ্ছেদে অনবরত বেরিয়ে আসবে স্বাধীন বাংলাদেশের উৎস, বাঙালির বিজয় গাঁথা আর যত গৌরব তার সব কিছু। হয়তো কুয়াশাও এতে থেকে যাবে। কিন্তু সেই তুলনায় প্রাপ্তির অংকটা কম কিসে। আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে যদি চিনতে পারি, উৎস যদি বুঝতে পারি তবেই জাতি হিসেবে আমরা আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে এ গর্বিত উচ্চারণ করতে পারবো-আমরা বাঙালি আমাদেরও আছে বীরগাঁথা। সেই বীর গাঁথার একজন মহানায়কও আছেন।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা