আতাউর রহমান
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির যত কিছু মহৎ অর্জন তার সবই অর্জিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। একটি জাতির কাছে একটি দেশের স্বাধীনতার চেয়ে বড় অর্জন আর কিছু হতে পারে না।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশের রাজধানী পুরানো ঢাকার কে.এম. দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এক কর্মী সমাবেশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।
১৯৮১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৮বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরে সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী হিসেবে খ্যাত বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, তা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা পিছিয়ে দিয়েছিল। ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকেও কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করে। আইনের শাসন রুদ্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় অর্থনীতির চাকাও। সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে। শুরু হয় হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে গাড়িতে তুলে দেন জিয়ারউর রহমানের দল বিএনপি ও তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে ফেলে রাখা হয়। চরম সেই সংকটাপন্ন অবস্থায় ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আন্দোলন-সংগ্রাম জীবনদানের পর দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তখন থেকে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সংসদকে সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত পানি বণ্টন চুক্তি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি করে দীর্ঘ দিনের হানাহানি রক্তপাত বন্ধ করা হয়। আইনের শাসন চালু হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মর্যাদা পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই পাঁচ বছরের সময়কাল জাতির ইতিহাসে এক সুবর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামাতের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির হাতে চলে যায়। জঙ্গি উত্থান ঘটিয়ে পুরো দেশকে পরিণত করা হয় মৃত্যু উপত্যকায়।
আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে শেখ হাসিনার ওপর একের পর এক গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে নারী নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ-এ.এ.এস.এম কিবরিয়া ও প্রখ্যাাত শ্রমিক নেতা গাজীপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ বহু নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের পাশাপাশি হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করা হয়। পছন্দের লোকের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তাকে রাজনীতি থেকে বিছিন্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সুশীল সমাজ নামধারী একটি গোষ্ঠী মাইনাস টু ফরমুলা দেয়। দলের অনেক নেতাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেই ফরমুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। কিš‘ আওয়ামী লীগ কর্মীরা শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন বলেই তারা সে দিন সেই মাইনাস টু ফরমুলা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে প্রমাণ হয়েছে, সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। যখনই আওয়ামী লীগ কোনো সংকটে পড়েছে, তখনই কর্মীরা দৃঢ় ইস্পাত ঐক্য গড়ে তুলে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করেছে। তীব্র জনমতের কাছে ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হয় বারে বার। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারও আওয়ামী দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। সেই থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। দেশের আর্থ- সামাজিক অবস্থা অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। মাথাপিছু আয় ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা, দরিদ্রমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিš‘ ঘাতকরা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ লাখ লাখ নেতাকর্মী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার পাশে থাকবে। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৭১ সালে আমি তখন ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি। তবে আমার চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগের এমপি ও শ্রমিক নেতা শহীদ আহসান উল্লাহ (মাস্টার হিসেবে পরিচিত), অলিউল্লাহ, শহিদউল্লাহসহ হায়দরাবাদ গ্রামের বহু আত্মীয়স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। তারা যখন গ্রামে আসেন তখন তাদের অনেক ঘটনা ও খবর-আদান প্রদানে আমি ভূমিকা পালন করেছি। পাক হানাদার বাহিনীর অনেক ঘটনা আজো আমার মনে পড়ে। যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তুঙ্গে তখন আমার সামনে অনেক মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি। পাক হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে দুইবার হামলা করে লুটপাট করেছে। আহসান উল্লাহ ভাইকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিš‘ আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে পেরেছিলেন। আমি ছোট বলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারলেও তখনকার অনেক ঘটনা আজো মনে পড়ে বারেবার।
একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খাচ্ছে, অন্যদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পাকিস্তানি সেনা আর তাদের এ দেশীয় দোসরদের গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোনো রকমে প্রাণটা নিয়ে প্রতিদিন হাজারে হাজারে শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কাছে তাদের অনেক কথা জানান। মুক্তিযোদ্ধারা জানায়, তখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষের কাছে বাংলাদেশের নাম হয়ে গেল ‘জয় বাংলার লোক’। অনেক শহরে বাসে চড়লে বা হোটেলে খেলে পয়সা নিত না। পূর্ব বাংলার মানুষের ব্র্যান্ড নাম তখন ‘জয় বাংলা’। একসময় দেশ শত্রুমুক্ত হলো। কিছুদিন পর নতুন দেশের মানুষের জন্য নতুন পাসপোর্ট তৈরি হলো। সেই পাসপোর্ট নিয়ে বাঙালি প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে গেল। বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনরত অনেক দেশের ইমিগ্রেশন অফিসারদের কাছে নতুন দেশ বা তার নতুন পাসপোর্ট তেমন একটা পরিচিত নয়। আমাদের দেশের লোকজন যখন বিদেশে যেতেন তখন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তখন বলা হতো, ‘বঙ্গবন্ধুর দেশের লোক।’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন অফিসার বলতেন, ‘ও, মুজিব কান্ট্রি।’ বলেই সিল মেরে দিতেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত অনেক দেশই বাংলাদেশকে ‘মুজিব কান্ট্রি’ নামে চিনত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন ছিলেন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিদেশে বাঙালিদের অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে বলে দেশের প্রবীণ লোকজন প্রায়ই সভা-সমাবেশে বলতেন। আবুদল মান্নান নামে একজন আওয়ামী লীগ নেতা তার বিদেশ সফরের একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এক প্রতিবেদনে বলেন, ১৯৭৭ সালের মে মাসে শিকাগো শহরের এক কৃষ্ণাঙ্গ ট্যাক্সিচালক আমার কাছে জানতে চাইল আমি ভারতীয় কি না। জবাবে বলি—না, বাংলাদেশের। সঙ্গে সঙ্গে সেই ট্যাক্সিচালক বলে, ‘তোমরা তোমাদের গ্রেট লিডারকে হত্যা করেছ।’ এক কথায় আমি লা জবাব। ১৯৮০ সালেও আমি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম প্যারিসে। বঙ্গবন্ধুর পর বাঙালিকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর পাওয়ার জন্য।
অনেকে হয়তো আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাবেন, যদি বলি এই মুহূর্তে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, যিনি এখন আন্তর্জাতিক মহলে ‘মানবতার জননী’ (Mother of Humanity) নামে পরিচিত। আরব আমিরাতের বহুল প্রচারিত দৈনিক খালিজ টাইমস শেখ হাসিনাকে ‘পূর্ব দেশের নতুন তারকা (New Star of Eastern Country)অভিধায় ভূষিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস শেখ হাসিনকে বিশ্বের ত্রিশজন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় স্থান দিয়েছে। রানি এলিজাবেথ থেকে শুর“ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত যখন অর্থপাচারের দায়ে অভিযুক্ত, তখন শেখ হাসিনাকে পিপল’স অ্যান্ড পলিটিকস নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের তৃতীয় সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বলে রাখা ভালো, এই সব টাইটেল বা স্বীকৃতি কোনো লবি করে পাওয়া নয়। কখনো কখনো দেশ দিয়ে মানুষ পরিচিত, আবার উল্টো মানুষ বা নেতা দিয়ে দেশ পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ দেশের মানুষ অনেকটা শেখ হাসিনাকে দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই পরিচিত হচ্ছে। ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ’ বললে উত্তর আসে, ‘ও, শেখ হাসিনা তোমাদের প্রধানমন্ত্রী।’ দেশে ও দেশের বাইরে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কসুলভ কিছু অর্জনের কারণে তিনি এখন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। পেছনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনার রাতে ফিরে গেলে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তাঁরা দুজন দেশের বাইরে ছিলেন বলে ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ঘটনার রাতে দুজনই বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় ছিলেন। এই রাষ্ট্রদূতকে পদায়ন না করতে বঙ্গবন্ধুকে অনেকে নিষেধ করেছিলেন। কিš‘ বঙ্গবন্ধু কখনো বিশ্বাস করতেন না কোনো বাঙালি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। তিনি পরবর্তীকালে এই সব ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়েছিলেন। সেই রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে অনেকটা জোর করে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন জার্মানিতে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ইউরোপ সফরে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন একটি সংবাদ সম্মেলন করার জন্য, যেখানে তিনি একা তাঁর পিতা ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরবেন। ড. কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এই সব কথা বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেকবার বলেছিলেন।
মনে রাখা ভালো, ড. কামাল হোসেনের রাজনীতিতে আসা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বিদেশে শরণার্থীর জীবন যাপন করেছেন। ভারতে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন সে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর বিজ্ঞানী স্বামীর জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। শেখ হাসিনার প্রতিবেশী ছিলেন ড. কবিতা শর্মা। তাঁর স্বামী ও ভাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ড. শর্মা বর্তমানে দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়) প্রেসিডেন্ট (উপাচার্য)। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁদের এই নতুন প্রতিবেশী যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা তা তাঁরা অনেক পরে জেনেছেন; কারণ দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বিকেলে শেখ হাসিনা অনেকটা ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দিল্লি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই বিকেলটা ছিল বেশ ঝোড়ো ও বৃষ্টিস্নাত। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানাতে সেদিন ঢাকার রাজপথে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। এমনটি দেখা গিয়েছিল শুধু পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। শেখ হাসিনাকে স্বদেশের মাটিতে স্বাগত জানাতে ঢাকায় যে জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছিল, তা দেখে এটি মনে হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল যে এই দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘদিন তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করেছে। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার সব ছিল। ফিরলেন একাকী, বুকের ভেতর একরাশ হাহাকার নিয়ে। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে আসা লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বুঝলেন, আগামী দিনে এই নিঃস্বার্থ লাখো মানুষই হবে তাঁর পথচলার অনুপ্রেরণা। ঢাকায় তখন শেখ হাসিনার থাকার জন্য নিজের একচিলতে আশ্রয় নেই। উঠলেন ফুফুর বাসায়। স্বজন হারানোর প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নেমে পড়লেন দল গোছানোর কাজে। সে সময় শেখ হাসিনার সুবিধা ছিল, তখন দলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত একঝাঁক নিবেদিত নেতাকর্মী ছিল, যাদের অনেকেই বর্তমানে হয় প্রয়াত বা বয়সের ভারে ন্যুব্জ। শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য যে গত তিন দশকে যারা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নৌকায় উঠেছে, তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে না, নিজের স্বার্থের বাইরে এককদমও পা ফেলে না, অবস্থা বেগতিক দেখলে অন্যের আশ্রয়ে চলে যেতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে না। একই কথা সামরিক-বেসামরিক আমলাদের বেলায়ও প্রযোজ্য, যাঁরা তাঁর শাসনামলে বেশুমার সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বে এবং দূরদর্শিতার ফলে অনেক চড়াই-উতরাই আর ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দীর্ঘ একুশ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এলো, তখন রাতারাতি ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনের জন্ম হলো, যাদের বেশির ভাগই ছিল সুযোগসন্ধানী। এদের চরিত্র হচ্ছে উইপোকার মতো। এই উইপোকাদের দাপটে প্রকৃত কর্মীরা এখন অনেকটা কোণঠাসা। এই উইপোকারা এখন বেশ সক্রিয়; এবং এই সব মোকাবেলা করেই একজন শেখ হাসিনা উজান স্রোতে নৌকা ঠেলে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটি নতুন পরিচয় দিয়েছেন, যাকে বলে আইডেন্টিটি।
শেখ হাসিনার তিন মেয়াদে অনেক কীর্তির মাঝে নিশ্চিতভাবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ অমর হয়ে থাকবে। পিতা বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন আর কন্যা সেই দেশের মানুষকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করেছেন। শেখ হাসিনার মেয়াদকালে দেশে উন্নয়ন হয়েছে, তা অস্বীকার করতে যেসব সুধীজন অহর্নিশ চেষ্টা চালান, তাঁরাও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন এবং কখনো কখনো ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার চেষ্টা করেন।
শেখ হাসিনা বর্তমানে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন রাষ্ট্রনায়ক। ২০১৭ সালে বিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকা যে চারটি দেশকে বর্ষসেরা দেশ হিসেবে ঘোষণার জন্য বিবেচনা করেছিল তার মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশও ছিল। সার্বিক বিচারে তারা দক্ষিণ কোরিয়াকে নির্বাচিত করে। ২০১৭ সালে শেখ হাসিনার সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হাতে ভয়াবহভাবে নিগৃহীত হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তটি। দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যত শরণার্থী ইউরোপে গেছে, বাংলাদেশে উনিশ দিনে ততজন আশ্রয় নিয়েছে। শেখ হাসিনা কক্সবাজারে সেই সব আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করতে গিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা যদি ষোলো কোটি মানুষকে অন্ন জোগাতে পারি তাহলে বাড়তি ১০ লাখ জনেরও অন্ন জোগাতে পারব।’ অবশ্য বর্তমানে সেই আশ্রয় গ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখে ঠেকেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা যখন এই সমস্যার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন তখন তিনি শুধু নিজেকে নয়, বাংলাদেশকে অন্য উ”চতায় নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের দেশ। বিশ্বে ৩৩তম অর্থনীতি (পিপিপি হিসাবে)। মাথাপিছু গড় আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। গত এক দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ ছিল (চলতি আর্থিক বছরে ৭.২৮ শতাংশ)। সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এই সব অর্জন অস্বীকার করি কিভাবে? বাংলাদেশ কোনো উন্নত দেশের ক্লাব, যেমন জি-৭ বা জি-১০ এর সদস্য নয়। সেই ক্লাবের সদস্যরা তাদের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের ভাষায় ‘বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর উন্নয়নের’ মন্ত্র জানতে চায়। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র করেছে, যার সঙ্গে এ দেশের কিছু সুধীজনও জড়িত ছিল।
সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিভাবে করতে হয় তা বাংলাদেশ থেকে শিখতে পারো। বাংলাদেশ কিভাবে জঙ্গিবাদ দমন করেছে তা-ও এখন অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে শিখতে চায়। রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করে শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে বিশ্বের পরমাণু ক্লাবের ৩২তম সদস্য করছেন। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন তখন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল আনুমানিক ৩ হাজার মেগাওয়াট। গত আট বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদিত হয়, কারণ দেশের বিতরণব্যবস্থা এর বেশি বিতরণ করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অন্য এক উ”চতায় নিয়ে গেছেন ঠিক, তবে তাঁকে ঘিরে শঙ্কাও কম নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে সেদিন তাঁর জন্য যে বুলেট বরাদ্দ ছিল তা তাঁকে এখনো তাড়া করছে। এ পর্যন্ত তিনি ২১/২২ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় সমাবেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যা মিশন। দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন দিয়ে শেখ হাসিনাকে সেদিন রক্ষা করেছেন। সেই গ্রেনেড হামলার কুশীলবরা এখনো বাংলাদেশ, লন্ডন, পাকিস্তান, দুবাইসহ একাধিক দেশে সক্রিয়। দলের ভেতরে যেসব উইপোকা বাসা বেঁধেছে, তারা সময়মতো দলের সর্বনাশ করার জন্য সদা প্রস্তুত। সামনে জাতীয় নির্বাচন এলে তাদের অনেকের মুখোশ খুলে যাবে।
হয়তো আগামীতে শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য সময়মতো বহুমাত্রিক জোট হবে। সেখানে আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার বিরোধীরা তো থাকবেই, সঙ্গে যুক্ত হবে দেশের বেশ কিছু শক্তিশালী মিডিয়া, পরিচিত ‘নিরপেক্ষ’ সুধীজন আর অতি পরিচিত কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি। এই সব মোকাবেলা করার দায়িত্ব এককভাবে একজন শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিলে তা হবে মহাঅন্যায়। একজন শেখ হাসিনাকে ঘিরেই দেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন । কারণ তিনি তাদের একটি পরিচয় দিয়েছেন। জাতির পিতার মতো শেখ হাসিনার পদচিহ্নও এই দেশে হাজার বছর থাকুক এই প্রত্যাশা দেশের কোটি কোটি জনতার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা