অনলাইন ডেস্ক
শুক্রবার বিপিএলের শিরোপা জিতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের উদযাপন থামে রাত ২টা নাগাদ। এরপর যার যার রুমে। বরিশালকে ৬ বলে ১০ রান নিতে না দিয়ে কুমিল্লার শেষের নায়ক ছিলেন শহীদুল।
‘দানে দানে তিন দান’- কথার কথা প্রবচন। আর ক্রিকেটীয় পরিভাষার ল অফ এ্যাভারেজ। শুধু মুখে আর লিখায় নয়, বাস্তবেও যে সত্য হয় তা শহীদুল করে দেখিয়েছেন। একবার নয়, দুইবার নয়, শহীদুল ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনটি শিরোপা জিতেছেন শেষ ওভারে দারুণ বোলিংয়ে। এবারের বিপিএলের আগে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে শেষ ওভারে বাজিমাত করেছেন তিনি। ঢাকা লিগে আবাহনীর হয়ে প্রাইম ব্যাংকের বিপক্ষে ১৬ রান পুঁজি করে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন ৮ রানে।
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে জেমকন খুলনার হয়ে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে ১৬ রান নিয়ে ম্যাচ জেতান ৫ রানে। এবার আরও কঠিন পরিস্থিতি ছিল। ৬ বলে দরকার ১০ রান। শহীদুল ৮ রান দিয়ে ম্যাচ জেতান ১ রানে।
ডেথ ওভারে বোলিংয়ে স্নায়ু স্থির রাখা কঠিন। শহীদুল সেই কাজটা করে আসছেন সিদ্ধহস্তে। কিভাবে সম্ভব? রাইজিংবিডির মুখোমুখি হয়ে কথার ঝাঁপি খুললেন ডানহাতি পেসার। তার কথা শুনেছেন ইয়াসিন হাসান।
বিপিএলে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন হলেন। কতোটা আনন্দিত? শহীদুল ইসলাম: আলহামদুলিল্লাহ ভালো লাগছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতিটা তো অন্যকরম। আমি নিজে বেশ খুশি। কুমিল্লায় খেলার ইচ্ছে ছিল। ড্রাফট থেকে তারা আমাকে নেয়। তাদের শিরোপা দিতে পেরেছি এজন্য ভালো লাগছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খুশিটা তাই বেশি।
আপনি শেষ মুহূর্তে গিয়ে কুমিল্লার নায়ক হয়েছেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৬ বলে ১০ রান নেওয়া কোনো ব্যাপারই না। অথচ এই রানটাও হতে দেননি আপনি। কোন পরিকল্পনায় এগিয়েছিলেন? শহীদুল ইসলাম: শেষ ওভারের আগে ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে বলতে চাই। ফাইনালের পরিকল্পনার শুরুতেই কোচ আমাদের বলেছিলেন যেই দল স্নায়ু স্থির রাখতে পারবে তারা জিতবে। আমার তার কথাটাই বারবার মনে পড়ছিল। সত্যিই তাই। ফাইনালে স্নায়ু স্থির রাখাতেই আমরা জিতেছি। সাকিব ভাইও প্রেজেস্টেশনে একই কথা বলেছেন। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের মৌলিক কাজগুলো ঠিকমতো করবো। ভুল কম করবো। তাহলেই হবে। শেষটা যে ভালো করবে তাদেরই সফল হওয়ার সুযোগ বেশি থাকবে। ওভাবেই সবাই চেষ্টা করেছি। যা হবে সেটা নিয়েই লড়াই করতে হবে।
শেষ ওভারের পরিকল্পনা নিয়ে বললেন না… শহীদুল ইসলাম: জিততে হলে আমাকে ১০ রান ডিফেন্ড করতে হবে এটা আমার জানা ছিল। আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রথম বল। প্রথম বলটায় যেন বাউন্ডারি না হয় সেটা আমার পরিকল্পনাতেই ছিল। যদি হয় তাহলে এগিয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস পেয়ে যাবে। এজন্য ওই বলটা আমি পুরো মনোযোগ দিয়ে করেছি। প্রথম বল ডট হওয়ার পর বুঝেছি ম্যাচটা আমার। এরপর প্রত্যেকটি বল নিয়ে আলাদা আলাদা করে ভেবেছি যেন বাউন্ডারি না হয়।
আপনি ওয়াইড ইয়র্কার বলটা বেশি করেছেন। ব্যাটসম্যান নাগাল যেন না পায় সেই চেষ্টাই কি করেছিলেন? শহীদুল ইসলাম: শেষ দিকে ব্যাটসম্যানরা আক্রমণাত্মক মানসিকতা নিয়ে ব্যাটিং করেন। তাদের পরিকল্পনা থাকে যেমন বলই আসুক আমাকে মারতে হবে। তাই ওয়াইড ইয়র্কার কিংবা ফুলার লেন্থ সুইং বল করা উচিত। আমি সেই কাজটাই করেছি। ব্যাটসম্যানরা যেন নিজেদের শক্তিশালী জায়গায় বল না পায়। ওয়াইড ইয়র্কার বলগুলো ব্যাটসম্যানরা সহজেই নাগাল পায় না। আমাদের ব্যাটসম্যানদের এটা একটা দূর্বলতার জায়গা। আর তৌহিদ লেগ সাইডে ভালো খেলে। তাই ওর থেকে বল দূর রাখার চেষ্টাই করেছি।
আপনাকে নিয়ে মোটামুটি একটা মিটিং হয়ে গিয়েছিল শেষ ওভারের আগে। কি আলোচনা হয়েছিল? শহীদুল ইসলাম: শেষ ওভারে সবাই এসে আলোচনা করছিল কাকে দেয়া যায়। ইমরুল ভাই আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন আমি বল করবো। ওরা সবাই এসে তাই আলোচনায় যোগ দেয়। সবাই সবার ভাবনাগুলো ভাগাভাগি করছিল।
তানবীর যখন ক্যাচটা ছাড়ছিল তখন কি মনে হচ্ছিল রাজ্যের হতাশা আপনার ওপর ভর করেছে? শহীদুল ইসলাম: নাহ নাহ। ও ক্যাচ ছেড়েছে আমি ওই কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কারণ, ক্যাচ ছাড়ার পর ও আবার থ্রো করেছিল। বলটা তো ধরতে হবে। আর আমি যদি হতাশ হয়ে যাই তাহলে বোলিং থেকে দূরে সরে যাবো এমন ভাবনাও কাজ করছিল। তাই খুব বেশি কিছু চিন্তা করিনি। ও তো ওর মতো করে চেষ্টা করেছে। কেউ তো ইচ্ছা করে ক্যাচ ছাড়ে না। পরে ওকে আমি অনুপ্রাণিতও করেছি।
শেষ বলে তো একটা বাউন্ডারি হয়ে গেলেই বরিশাল জিতে যেতো। আপনার মনে কি চলছিল? একবারও কি ভয় কাজ করছিল? শহীদুল ইসলাম: শেষ বলটায় একটু চিন্তা এসেছিল…কি করা যায় না করা যায়। কিন্তু মনে মনে ভাবছিলাম এর আগে তো দুইটা ফাইনালে আমি বল করে জিতিয়েছি। এবারও পারবো। ওই আত্মবিশ্বাসটা ছিল আমার। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেই আমি সফল হয়েছি।
ইমরুল কায়েস নাকি বলেছিলেন, ‘হিরো হওয়ার সুযোগ একবারই পাওয়া যায়। আজকে তোর দিন…।’ শহীদুল ইসলাম: হ্যাঁ, উনি আমাকে শেষ ওভারে খুব সাহায্য করেছেন। মানসিকভাবে সাহায্য করেছেন। খুব ভালো অধিনায়ক তিনি। একটা কথাই বলেছিলেন, মনে যেটা আসবে সেটা করবি। অন্য কিছু চিন্তার দরকার নেই। ইয়র্কার করলে ইয়র্কার, ওয়াইড করলে ওয়াইড। দুই রকম চিন্তার দরকার নেই।
ফাফ ডু প্লেসি, মঈন আলীরা এসব ম্যাচ হরহামেশা খেলেন। আপনাদের জন্য নতুন। কিন্তু তারা কি বলছিলেন… শহীদুল ইসলাম: উনারা তো বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। সারা পৃথিবী ঘুরে খেলেন। উনাদের সঙ্গে খেলা ভাগ্যের বিষয়। খুবই বন্ধুত্বপরায়ণ তারা। দুইজনই আমার সঙ্গে এসে খোলামেলা কথা বলেছেন। কোনো টিপস না। উনারা মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন যেটা খুবই সাহায্য করেছে আমাকে। শুধু ম্যাচেই নয়, উনারা আমাকে নেটে বোলিংয়ে এসে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন। উনারা ম্যাচ দারুণভাবে বুঝতে পারেন। কোন দিকে যাচ্ছে সেগুলো ধরতে পারেন। সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
কোনো ফাইনালের অভিজ্ঞতা কথা শেয়ার করেছেন? কয়েক মাস আ
গে তো তারা একসঙ্গে আইপিএল ফাইনাল খেলেছিলেন… শহীদুল ইসলাম: কোনো নির্দিষ্ট ফাইনালের কথা তারা বলেননি। তবে ফাইনাল নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করেছেন। যেমন ফাফ শুরু থেকেই বলছিল, অন্য দশটা ম্যাচের মতো করে যদি খেলি তাহলে ম্যাচটা আমরা জিততে পারবো। মঈনও তাই। মৌলিক বিষয়গুলোতে জোর দিয়েছিলেন। কম ভুল করার কথা বলেছেন। আর প্রতিপক্ষ কে আছে সেগুলো মাথায় না আনতে। খুব সহজ চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকেন। কোনো জটিল বিষয় নয়। সহজ চিন্তাধারা কিন্তু ফলটা অনেক বড়।
শেষ বলটা করলেন। তৌহিদ মারলো। ইমরুল ধরে লিটনকে দিল। লিটন স্ট্যাম্প ভাঙলো। চোখের সামনেই সব কিছু ঘটে গেলো আপনার। তাৎক্ষণিক কেমন লেগেছিল? শহীদুল ইসলাম: শেষ বলের আগে আমি ইমরুল ভাইকে ডেকে সবাইকে সতর্ক করতে বলি। কারণ, ৩ রান দরকার। ২ রান হলে টাই। আমি বলেছিলাম কেউ যেন বল নিজের কাছে না রাখে। বল যেন থ্রো করে। থ্রো-টা যেন ভালো হয়। ব্যাকআপ যেন থাকে। ইমরুল ভাই ধরে যখন লিটনকে দিলেন। স্টাম্পটা যখন ভাঙলো আমার থেকে বেশি খুশি মনে হয় না অন্য কেউ হয়েছিল। খুব ভালো লেগেছিল।
রাতে উদযাপন কেমন হলো? শহীদুল ইসলাম: উদযাপন হয়েছে মোটামুটি ভালোই।
বাড়তি কি বোনাস পাচ্ছেন দল থেকে? শহীদুল ইসলাম: ওইটা এখনও ঘোষণা করেনি।
কেন নাফিসা কামাল, আপনাদের চেয়ারম্যান কিছু দেবেন না? সে তো অনেক আনন্দিত? শহীদুল ইসলাম: না আমাকে কিছু বলেননি এখনও।
পুরো বিপিএলর জার্নি কেমন ছিল? শহীদুল ইসলাম: পুরো সফরটা ভালোই ছিল। আমি তো শেষ কয়েক বছর সুজন স্যারের (খালেদ মাহমুদ) সঙ্গে খেলেছি। বাবুল স্যারের অধীনেও ছিলাম। সালাউদ্দিন স্যারের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। কুমিল্লায় খেলার ইচ্ছা ছিল। শুধু কুমিল্লায় না বরিশাল ও ঢাকায়ও খেলার ইচ্ছা ছিল। শেষমেশ সালাউদ্দিন স্যার আমাকে নেন। দলটাও বেশ ভালো ছিল। বেশ গোছানো ম্যানেজমেন্ট। সবকিছুই আছে। খেলাধুলা, এন্টারটেইনমেন্ট সব কিছুই ভালো।
এর আগেও আপনি জেমকন খুলনার হয়ে শেষ দিকে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। ঢাকা লিগেও এমন কীর্তি আছে। এভাবে স্নায়ু স্থির রাখেন কিভাবে? অবিশ্বাস্য শক্তির প্রয়োজন হয়… শহীদুল ইসলাম: আমার কাছে মনে হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটাই হচ্ছে শেষ ওভারের খেলা। আর শেষ ওভার মানেই স্নায়ু পরীক্ষা। এটা যে যতো ভালো করে কন্ট্রোল করতে পারে তার জয়ের সুযোগ থাকে তত বেশি। সেক্ষেত্রে ব্যাটসম্যান যদি স্নায়ু ঠিক রাখতে পারে তাহলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদি বোলার রাখতে পারে তাহলে বোলারের বেড়ে যায়। আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব স্নায়ু স্থির রাখতে। এতে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। ওই সময়ে আসলে ফলাফলের দিকে না তাকিয়ে নিজে কি করতে চাচ্ছি, কি করবো…শুধু এতোটুকু চিন্তা করতে পারলেই হবে। ফলাফল নিয়ে ভাবলে অন্য কিছু হয়ে যেতে পারে। এরকমই চিন্তা করতে থাকি যেন অন্য কিছু মাথায় না আসে।
এরকম মুহূর্তে পরিবারের বা কাছের মানুষের কথা মনে পড়ে বা ছবি ভেসে আসে চোখের সামনে। আপনি তো বাবার খুব কাছের ছিলেন। বাবাকে হারিয়েছেন। তার কথা কিংবা কারো কথা কি মনে পড়েছিল? শহীদুল ইসলাম: ম্যাচের আগে আব্বুকে খুব মিস করি। খেলতে যাওয়ার আগে আমি সব সময় আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলে যেতাম। আব্বু নেই। এখন আম্মুর সঙ্গে কথা বলি। আব্বুকে ভোলা কোনোদিনও সম্ভব না। কালকেও মনে পড়েছিল। প্রত্যেক ম্যাচের আগেই ভাবি উনার কথা।
সামনেই জাতীয় দলের সিরিজ আছে। কি ভাবনা কাজ করছে? শহীদুল ইসলাম: নিজের শতভাগ অ্যাফোর্ট দেবো এতোটুকুই। আমার ভূমিকা অনুযায়ী কাজ করবো।
একটু বলবেন নিজের বোলিংয়ে কোন দিকগুলো নিয়ে কাজ করেছেন শেষ এক বছরে। কোথায় উন্নতি করেছেন? শহীদুল ইসলাম: আমি তো কোনো ক্যাম্পে ছিলাম না। শেষ কয়েক মাস ভালোভালো কোচদের অধীনে কাজ করেছি। এখানেই উন্নতি হয়েছে। জাতীয় দলে থাকাকালিন ওটিস গিবসনের সঙ্গে কাজ করেছি। কিছু জিনিস শিখিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেগুলো নিয়ে কাজ করেছি। আমার স্টক বল, স্লোয়ার নিয়ে কাজ করেছি উনার সঙ্গে। নিজের বোলিংয়ে এখনও ভুল আছে। সেগুলো দূর করতে হবে।
ব্যাকহ্যান্ড স্লোয়ারটা কি করেন না… শহীদুল ইসলাম: এবারের প্ল্যান ছিল অন্যরকম। একেক সময় একেক দলের একেক পরিকল্পনা থাকে। এবারের পরিকল্পনা এরকম ছিল না। নেটে অনুশীলন করেছি। তবে ম্যাচে পরিকল্পনা ছিল না। ডে ম্যাচ, নাইট ম্যাচ ধরে ধরে এগিয়েছি।
গতি কি বেড়েছে? শহীদুল ইসলাম: এবার তো দেখার সুযোগ পাইনি। গতি নিয়ে কিছুদিন হলো কাজ করছি না। তবে বোলিং করে মনে হলো কিছুটা বেড়েছে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা