জাকির আজাদ
দীপ্র কারো কথা শুনছে না। তার যখন সেটা করতে ইচ্ছে করছে তাই করছে। পড়ার সময় টিভি দেখছে কিংবা গেমস খেলছে। হোম টিউটার এলে নানা অজুহাত ধরে পড়তে চাচ্ছেনা। স্কুলে নিয়মিত গেলেও হোম ওয়ার্কের জন্য নিজে যখন বকুনি খাচ্ছে তেমনি খাতায় অভিভাবকদের জন্য অবগতি নোট নিয়ে আসছে টিচারদের।
আট-দশটা শিশুর মতো আচরণ করছে না। স্পস্ট করে কিছু বলছেনা,বা কোনো চাহিদা কথা জানাচ্ছে। দিনভর মুখ গুজে থাকে। আপনমনে নিজের মধ্যে বিচরণ করে। দীপ্র বয়স এখন দশ সে কনভেন্ট স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বাবা কুমিল্লা বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেডের সহকারী মুখ্য হিসাবরক্ষক। মা আলেয়া নাসরিন বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী ।
দীপ্র তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান। কি কারণে দীপ্র‘র এমন মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তা তারা অনুধাবন করতে পারছে না। শহরের নামী-দামী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলো। শিশুবিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে দীপ্র সেরে ওঠতে সময় লাগবে। সে কোনো ধরণের মানসিক আঘাতে অসুস্থ। তাই বাধ্য হয়ে বাবা নোমান শিকদার তাকে মনোবিজ্ঞানের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানালেন পারিবারিক অস্থিরতা জন্য তাই এমন পরিবর্তন হয়েছে। সে স্বাভাবিক শিশুর আচরণটি প্রয়োগ করতে ভুলে গেছে।
কেবল দীপ্র নয় আজ অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। পিতামাতার বচসা-ভুল বোঝাবুঝি ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা –বাবার মানোমালিন্য দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠে তার হতাশ অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। না অনিশ্চয়তার ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে এক অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মন সংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। প্রতিদিন পিতা-মাতার বিবাদের প্রত্যক্ষদর্শী বহু শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মাতা নির্যাতনের শিকার হয়া কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাদের সন্তানও জন্মের পর নানা প্রতিকূলতায় ভোগে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য এক জরিপে, দেশে পাঁচ থেকে ১৭বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫%শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে বেশি। মেয়েশিশুদের ১৭.৪৭%শতাংশের পাশাপাশি ১৯.২১%শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক হেলালউদ্দিন আহমেদ বলেন,“শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর । যে কোনো ধরণের অনাকাঙিক্ষত ঘটনার প্রতিক্রিয়া মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্থ করে। আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে। শিশুর মানসিক বিকাশে পিতা-মাতার ভালোবাসা, সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারে মাতাকে নির্যাতিত হতে দেখরে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মাতা-পিতার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সর্ম্পক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে। পিতাকে তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে।”
আজকের শিশু আগামীকালের কর্ণধার। আজ সেই শিশুরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মাতৃগর্ভে শিশুর একটা জীবন আছে। সেই জীবনের সুরক্ষার বিষয়টি শিশুর প্রথম অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের দারিদ্রের পাশাপাশি অশিক্ষা ও নানান কুসংস্কারের কারণে মাতৃগর্ভে ভ্রুুণে স্থিত হওয়া অবস্থা থেকেই অধিকাংশ শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন আর্ন্তজাতিক আইন। এতে বলা হয়েছে শিশু বেঁচে থাকা, শিশুর জন্মগত অধিকার, স্নেহ-ভালোবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, পুষ্টি, খাদ্য ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার,অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, খেলাধূলা, আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার। পঙ্গু শিশুদের বিশেষজ্ঞ ও সেবা শুশ্রুষা পাওয়ার অধিকার। দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ পাওয়ার অধিকার। সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার। ন্যাশনাল ট্রমা কাউসেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট ইশরাত শারমীন রহমান বলেন,“ পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত,অসহায়। শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাই সে যে কাউকে আঘাত করতে পারে। আবার সেও অন্যের কাছ থেকে আগাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশংকা তৈরি হয়।” একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে অভিভাবকরা বিশাল ভূমিকা পালন করতে হয়। তাঁদের ব্যক্তিগত আচরণ, পাঠাভ্যাস, সমাজের অন্য মানুষের প্রতি আচরণ, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমা ও উদারতার দ্বারা শিশুরা প্রভাবিত হয়। আর শৈশবে যদি একজন অভিভাবক তাদের মাঝে এসব মানবীয় গুণাবলি প্রবেশ করাতে পারেন তাহলে আজীবন তা শিশুদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করবে। আর তার জন্য অবশ্যই অভিভাবকদের হতে হবে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা মুক্ত, সমাজে প্রতিটি সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ,উদার, আর্ন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। অভিভাবকদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জরুরি। শিশুর ধারণক্ষমতা অনুসারে শিক্ষা দিলে সে সময়কাল পরবর্তীতে কালজয়ী বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। কঠোর শাসন, প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। তাছাড়া হচ্ছে শিশুর শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম । শিশুর মনে আনন্দেই তার দেহমনের শক্তির মূল উৎস। সুশিক্ষা,নিরাপত্তা, সুস্¦াস্থ্য সুরক্ষা ও ভালোবাসা দিয়ে শিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পূর্ণ বিকশিত করে তুলতে হবে। পৃথিবীতে কোনো শিশুই বিবেক নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি মানসিক গুনাবলি নিয়ে জন্ম গ্রহন করেনা। আবার এতোসব সে একাকি শিখতে পারেনা। তাকে শিক্ষিত করতে হবে। শিশুর সঠিক বিকাশের স্বার্থে শিশুর প্রতি শাসনসুলভ মনোভাব এড়িয়ে গিয়ে বন্ধুসুলভ মনোভাব প্রকাশ করে তার সানিধ্যে যেতে হবে। শিশুর সুস্থ বিনোদনের ব্যাপারে পিতা-মাতাকে স্বশিক্ষিত হতে হবে তাদের ভাবনার জগতও প্রাসারিত হতে হবে। পারিবারিক বন্ধন হতে হবে সুদৃঢ়।
# সাংবাদিক-শিশু সাহিত্যিক, হোসেন মঞ্জিল,শাসনগাছা, কুমিল্লা।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা