দীর্ঘ পাঁচ/ছয় বছর পর, আমার এক ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। একই শহরে থাকি, অথচ যোগাযোগ নাই অনেকের সাথেই। দারুণ ক্রিয়েটিভ ছেলে বলে বরাবরই আমি ওকে খুব পছন্দ করি। পড়ার গন্ডি পেরিয়ে এখন ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছে আইটি বিষয়ক বিজনেস।
কথা প্রসঙ্গে বললো, আপু, আগামী পাঁচ বছর পর আমি আর এ দেশে থাকতে চাই না। আমি চাই না, আমার পরবর্তী প্রজন্ম এখানে বেড়ে উঠুক। অবাক হয়ে বললাম, তোর মতন প্রগতিশীল এবং সৃজনশীল মানুষ যদি দেশ ছেড়ে দেয় তাহলে এই দেশটা কোথায় দাঁড়াবে বলতো?
একটু হেসে বললো, আপু আপনার কি মনে হয়, এখানে আমাদের কাঙ্খিত ভবিষ্যত আছে? আমাদের আগের প্রজন্ম হিসেবে আপনারা কি যথাযথ জায়গাটা পেয়েছেন? বাংলাদেশে যথাস্থানে যথা লোকটা কি আসীন, দু’একটি পদ ছাড়া? আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। কারণ আমার কাছে কোন উত্তর নেই।
আমার অন্তত (সিনিয়র, সমবয়সী এবং জুনিয়র) দশজন সহকর্মী গত পাঁচ বছরে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ী বসতি গেড়েছেন।
অনেক বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনকেও দেখেছি একই রূপে। তাদের প্রত্যেকেরই এক কথা-দেশে কোন ভবিষ্যত নেই। স্বভাবতই একটি সহজ প্রশ্ন মনে জাগে- ভবিষ্যত গেল কই?
আমার ছোটবেলায় (৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে) শুনতাম, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীরা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ গেলে বিত্ত-বৈভবের রঙিন স্বপ্নে আটকে যেতেন। ছুটির পর ছুটি বাড়িয়ে থেকে যেতেন বিভিন্ন ডিগ্রি নেয়ার নামে।
অনেকে আবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেসব স্বপ্নের দেশে থেকে যেতেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। তখন প্রবীণদের কাছে শুনতাম, বাংলাদেশের মেধা কিনে নিচ্ছে বিদেশিরা। দেশকে মেধাশূণ্য করার পাঁয়তারায় ব্যস্ত দেশিয় গুটি কয়েক দালাল।
বলতেন, সরকার যদি একটু সুদৃষ্টি দেয়, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে তাহলে দেশের মেধা দেশেই থাকতো। সেসময় সরকারি চাকরিতে বেতন-ভাতা কম থাকায় অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন (বিশেষ কয়েকটি সরকারি খাত ছাড়া) সরকারি চাকরিতে।
তবে তখনও দেশ আগলে রাখার জন্য অনেক দেশপ্রেমিক ছিলেন, যারা মন-প্রাণ দিয়ে চাইতেন দেশেই থাকতে। দিন-রাত সততা আর নীতির মধ্যে থেকে কাজ করে যেতেন স্বাধীন এই বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে চলতে। অনেক মেধাবীরা বিভিন্ন দেশের স্কলারশিপ পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন নজীরও আছে বহু।
এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন দশক। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি প্রতিটি খাতে, অনেক উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্জনও নেহায়েত কম নয়।
গত দশ বছরে সরকারি চাকরিজীবীদের কয়েকগুণ বেড়েছে বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। তারপরও স্বস্তি নেই জনমনে। শান্তি নেই জীবনধারায়। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অন্নের সন্ধানে রাত-দিন এক করে খেটে-খুটেও অনেকেই পাচ্ছেন না সচ্ছ্বলতা।
গণ জমায়েতস্থল যেমন গণপরিবহন, বাজার, দোকানপাটের সামনে দাঁড়ালে শোনা যায়, অনেকেই খেদোক্তি করেন, এখন একটা শ্রেণির হাতে টাকা চলে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ ক্রমেই নি:স্ব থেকে নি:স্ব হচ্ছে। যা গত আট/দশ বছর আগেও তেমন প্রকট ছিল না।
গত এক দশকে নিত্যপণ্যের দর লাগামহীন ঘোড়ার মতো রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে তো ছুটছেই। এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সম্প্রতি বাঙালির রন্ধন উপকরণের অন্যতম উপাদান পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্যে প্রায় বাকরুদ্ধ সাধারণ জনতা; কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বুঝতেই পারছেন না কোথা থেকে কি হচ্ছে।
অর্থসূচকে আমরা এখনও স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে হাঁটছি। এরই মধ্যে আমাদের অনেক অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটছে। কিন্তু তা-ও দেশে থাকার মতো আস্থাহীনতা জেঁকে বসেছে অনেকের মনে।
দেশের চারপাশের অস্থিরতার আঁচ হয়তো অনেকের গায়ে লাগে না। কিন্তু সাধারণের জীবন অনেক সময় সেই তাপেই গলে যায়। অনেকেই বলেন, এই যে প্রতি বছর বছর সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ে, আরে সাথে সাথে বেড়ে যায় নাগরিক জীবনের ব্যায় ভার। প্রথম চাপটা পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠ তেঁতে উঠে।
তাদের মতে, সবাই তো আর সরকারি চাকরি করে না। পাঁচ-ছয় বছর আগেও প্রাইভেট সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন স্বচ্ছ্বলতায় অনেকেরই ঈর্ষণীয়। কিন্তু এখন বলতে গেলে ধরাশায়ী।
অনেককে বলতে শুনি, দেশে শিক্ষা খাত, সেবা খাত, প্রশাসন-সবদিকেই হতাশা। অনেকের মতেই গণমাধ্যম, শিক্ষা খাতকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার যা যা পদক্ষেপ দরকার, তার সবটাই করা হচ্ছে এই দেশে। যার ফলে সুন্দর, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত এখন অদৃশ্য কালো পর্দার অন্তরালে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কারা করছে, কেন করছে?
সবচেয়ে হতাশ দেখি তরুণ প্রজন্মকে, শুরুতে যা বলছিলাম। বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী-পুরুষদের বেশিরভাগই এখন দেশ ছাড়তে পারলেই যেন বাঁচে।
তরুণ প্রজন্মের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা উন্নত ভবিষ্যতের আশায়। কারণ বাংলাদেশে তারা কোন সুন্দর আগামী দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষ্যমতে, ক্রমাগত ফিকে হয়ে আসছে সোনার বাংলার সোনালী আভা।
এসব শুনে আমি বা আমার মতো অনেকেই হতাশ হই, কেন এরকম হচ্ছে আমাদের এই সোনার বাংলায়! উত্তর খুঁজতে গেলে কোন কূল-কিনারা পাই না।নিজেকেই প্রশ্ন করি, সত্যিই কি আমরা উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারছি না সন্তানদের, দেশবাসী কি আসলেই সুচিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে? দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা কি হাতে গোণা যায়, এমন পর্যায়ে চলে এসেছে? জানি না, আমারও জানা নেই সঠিক উত্তর।
আমি হতাশায় ডুবে যাই। তবে হতাশার মাঝেও আবার খুঁজতে চাই আশা জাগানিয়া বন্দর, যেখানে ভিড়বে সুন্দর ভবিষ্যতের নোঙ্গর। বইবে আনন্দের সুবাতাস। সেজন্য অবশ্যই দরকার সুশাসন নামের সেই কান্ডারীকে। যে টেনে ধরে রাখবে আমার দেশের মেধা, কর্মশক্তিকে।
নাসরীন গীতি, সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
Like & Share our Facebook Page: Facebook
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা