নারীর অধিকারের কথা তুলে ধরতে কেবল নারীরাই নয় পুরুষদেরও অংশগ্রহণ থাকা আবশ্যক। একইভাবে তরুণদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে তরুণীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
আদিবাসী নারীদের মানবাধিকার বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় একথা বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাখীদাশ পুরকায়স্থ। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আনোয়ারা বেগম – মুনিরা খান মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাখীদাশ পুরকায়স্থ বলেন, আদিবাসী নারীরা গোটা দেশে যেসকল নারীরা আছেন তাদেরই অংশ। বাংলাদেশের নারীরা পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়, আদিবাসী নারীরাও গোষ্ঠীগত কারণে, ভিন্ন অবয়বের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ আদিবাসীদের অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে আদিবাসীদের জন্য প্রকাশিত সনদে উল্লেখ করলেও তারা তাদের অধিকার পাচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষ সকলের জন্য মৌলিক অধিকার সমান বলে উল্লেখ করলেও আদিবাসী নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্যে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আন্দোলন সম্পাদক রেখা চৌধুরী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর সকলকে নিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে সংগঠন।
সভার সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, মহিলা পরিষদের মূল চালিকা ঘোষণাপত্র গঠন তন্ত্র । ঘোষণা পত্রের ১৩ নং অনুচ্ছেদে আদিবাসী নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দায়িত্ব উল্লেখিত আছে। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করতে আজকের সভার সুপারিশ সাহায্য করবে। এই আন্দোলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও আদিবাসী নারীরা যৌথভাবে কাজ করে আদিবাসী নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, সামগ্রিকভাবে নারী সমাজ উপেক্ষার বস্তু। নারীকে সমানাধিকার দিতে কোন রাষ্ট্রই আগ্রহী নয়। সামগ্রিকভাবে নারী সমস্যার চিত্র আজকের সভায় যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সকলের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটের সাথে চিরন্তন সামরিক শাসন পাহাড়ের নারীদের জন্য কপালের লিখন। এটি যতদিন থাকবে ততদিন কোনো উন্নয়ন আসবে না। সংবিধানে আদিবাসীদের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। তাদের বিবেচনা করা হয় অবাঞ্ছিত হিসেবে। আদিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা কতটা অপ্রতুল সেটা সীতাকুন্ডের ঘটনায় প্রমাণ হয়।উচ্ছেদ এর উদ্বেগ ও আছে। নির্যাতনের ভয়ে, রোহিঙ্গা সমস্যা ইত্যাদি কারণে পাহাড়ীদের দেশত্যাগ বাড়ছে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের চাহিদাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এখনও।
আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা বলেন, আদিবাসী নারীদের জন্য আলাদা অধ্যায় থাকবে নারী উন্নয়ন নীতিমালায়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের বাইরে গেলে সরকার প্রধানরা বলেন বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। আমরাই আদিবাসী। সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে আমাদের বলা হলো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এটি আমাদের জন্য অবমাননাকর। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য যে বাজেট হয় তা সবার জন্য একই। আদিবাসীদের জন্য আলাদা কোনো বাজেট নেই। অন্যদিকে যেকোনো ঘটনায় নারীকে প্রধান টার্গেট করে তাদের নির্যাতন করা হয়।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের চলাচলে, মত প্রকাশে কোনো স্বাধীনতা নেই। সেখানে প্রশাসনের কড়া নজরদারি চলে। কড়া নজরদারির নামে প্রশাসন সেখানে আদিবাসী নারীদের উপর নির্যাতন চালায়। সমতলে থাকা আদিবাসীদের কোন স্বীকৃতি নেই। তাদের ভূমির অধিকার নেই। ভূমিগ্রাসীরা তাদের জমি দখল করে নেয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদীবাসীদের নেই তাই এসব ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে প্রথাগত বিশ্বাস, সামাজিক নিয়ম, শিক্ষার অভাবের কারণে প্রাইমারী স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়। ফলে বাল্যবিবাহ হয়। এসকল বৈষম্যমূলক অবস্থায় আমাদের অধিকার পাওয়ার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন : তুর্ণা নিশিথায় কেউ আহত হয়নি, সব যাত্রী উদয়নের
সভায় আদিবাসী নারীদের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ৩০ লক্ষ আদিবাসীর বসবাস রয়েছে বাংলাদেশে যাদের অর্ধেক অংশ নারী। আদিবাসী নারীদের উপর যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সাম্প্রদায়িক, রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলে আসছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হওয়ায় আদিবাসী নারীরা আরো বেশি বঞ্চনার শিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীরা কমই সুযোগ পেয়ে থাকে। সামরিক বিভিন্ন দ্বন্দ্ব – সংঘাতেও আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে।
তিনি বলেন, নিরাপত্তার অভাবে উঠতি বয়সের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হয়। ২০১৮ সালে সারাদেশে আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি প্রায় ৪৫ টির অধিক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। ৫৪ জনের অধিক আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গার্লস নট ব্রাইডস এর তথ্য মতে ১৮ বছর বয়সের আগেই শতকরা ৫৯ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এবং ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ২২ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর পেছনে দরিদ্র্যতা (খাদ্য ঘাটতি), শিক্ষায় প্রান্তিক অবস্থা, কর্মসংস্থানের অভাব, ভূমি থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি কারণ কাজ করে।
তিনি বলেন, অন্যদিকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ৫০ টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকলেও আদিবাসী নারীদের জন্য জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারের পরিষদগুলোতে কোন আসন সংরক্ষিত নেই। এমনকি জেন্ডার বাজেটে আদিবাসী নারীদের জন্য পৃথক কোনো বরাদ্দ থাকে না। তাই তিনি সুপারিশ করেন আদিবাসী নারীর সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতার শিকার নারীদের চিকিতসা ও আইনী সহায়তা প্রদান এবং নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের অবস্থাকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরা এবং সকল নীতিমালা গ্রহণের পূর্বে আদিবাসী নারীদের মতামত নেয়া ইত্যাদি।
সভায় মুক্ত আলোচনার অংশে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর প্রতিিিনধি এবং গার্লস নট ব্রাইডের উপদেষ্টা তাসনুভা জামান বলেন গার্লস নট ব্রাইড একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তথ্যের অভাব থাকে। আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করতে আমাদের আদিবাসীদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে হবে। প্রত্যেকের অবস্থা এক নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বদেশ চাকমা বলেন সীতাকুন্ডে অবস্থিত আদিবাসী এলাকায় এখনো বিদ্যুত নেই। প্রকৃত তথ্যের অভাব রয়েছে আদিবাসীদের সম্পর্কে। তাই ডাটা সংগ্রহের কাজ সরকার করবে কিনা সেটি তিনি প্রশ্ন রাখেন।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এডভোকেসি ও লবি শাখার পরিচালক জনা গোস্বামী।
ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা