ফজলুল বারী
নতুন বছরে সারাদেশের বাচ্চাদের হাতে উৎসব করে নতুন বই দেয়া হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দেয়া ব্রেইলি বই। নিজস্ব মাতৃভাষার বই দেয়া হয়েছে আদিবাসী শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের। ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটায় চলে আসছে এমন বই উৎসব। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে এসব বই উৎসবের ছবি, নতুন বই পেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ খুশি দেখে চোখ ভিজে আসে। এটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। কারন আমাদের শৈশবে এমন ফ্রি নতুন বইযোগ আমাদের ছিলোনা। নতুন বই পেয়ে খুশিখুশি বাচ্চারা যে সব প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তাতে আমাদের শৈশবকে মনে করিয়ে দেয়। যেমন ‘নতুন বইর গন্ধই আলাদা’। ‘আজ বাড়ি গিয়ে প্রতিটি বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবো পড়বো’। নতুন বই পেলে আমাদেরও মনেও এসব প্রতিক্রিয়া হতো। এরমানে সব যুগের সব কালের শৈশবেরই আনন্দ প্রতিক্রিয়ার ভাষা এক ও অভিন্ন।
বাংলাদেশে এই নতুন বই উৎসব একদিন-এক ইস্যুতে হলেও ধনী গরিবের ব্যবধান ঘুচে যায়। ধনী অভিভাবকের বাচ্চা, গরিব অভিভাবকের বাচ্চা দেখে এদিন আলাদা করে বই দেয়া হয়না। নতুন বই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ন একটি কথা বলেছেন শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। তাহলো নতুন বই প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে ফ্রি বই দেয়া স্বত্ত্বেও শিক্ষার গুণগত মানের কেনো উন্নতি হচ্ছেনা, তা নিয়েও একটি মত দিয়েছেন রাশেদা কে চৌধুরী।
আমাদের শৈশবের নতুন ক্লাসের বই স্মৃতি এখানে শেয়ার করি। আজকের বাংলাদেশের মতো বছরের প্রথম দিনেই এভাবে আমরা স্কুলে গিয়েই এভাবে ফ্রি বই পেতামনা। স্থানীয় লাইব্রেরিতে বই আসতে আসতে অনেক সময় ফেব্রুয়ারি এসে যেতো। অনেক সময় কালোবাজারেও বিক্রি হতো বই। আমাদের অনেকে, এমনকি আমিও পুরাতন বই নিয়ে পড়াশুনা করেছি। আমি একজন শিক্ষকের সন্তান। আমাদের পারিবারিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিলোনা। অনেকগুলো ভাইবোন থাকায় একজন আরেকজনের বই পড়েছি। তখন পুরনো বই কেনার দোকানও ছিল। অনেকে স্কুল ইয়ার শেষে বাচ্চাদের বই ওইসব দোকানে বিক্রি করে দিতেন। অস্বচ্ছল অভিভাবকরা ওইসব দোকান থেকেও বাচ্চাদের বই কিনে আনতেন। অনেক বাচ্চা আবার উপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কাছে বছর শেষে বই চেয়ে রাখতেন।
নতুন বই হাতে শিশু শাকিল।
পুরাতন-নতুন বই আনার পর এর প্রচ্ছদ টাটকা রাখতে যত্ন করে কভার তথা মলাট লাগানো ছিল আরেক পর্ব। এখন মলাট লাগানোর নানা রকম রঙ্গিন কাগজ পাওয়া যায়। আমাদের সময় উদয়ন, সোভিয়েত নারী এসব ম্যাগাজিন ছিল মলাট লাগানোর বিশেষ উপকরন। ঢাকার সোভিয়েত দূতাবাসের মাধ্যমে এসব ম্যাগাজিন ডাকযোগে ফ্রি পাওয়া যেতো। পুরাতন বই-কাগজের দোকানেও কিনতে পাওয়া যেত এসব ম্যাগাজিন। পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতা দিয়েও মলাটের কাজ চলতো। এখন স্কুলের বাচ্চারাও আঠা তথা গ্লুর কথা জানে। আমাদের সময়ে ময়দা পানিতে গুলিয়ে গরম করে আঠা বানাতে হতো। গাব নামের ফলটি কাঁচা অবস্থায় কেটে সেটির আঠাও কভারে বই মোড়াতে ব্যবহার করা হতো। বই বাঁধাইয়ের দোকানেও নিয়েও চলতো পুরান বই মুড়িয়ে নেয়া হতো। মলাটে বড় হরফে নাম, ক্লাস, স্কুলের নাম, রোল নাম্বার লিখার রেওয়াজ ছিল। ক্লাসে কারও বই হারিয়ে গেলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে হতো। গরিব বাবা রাগ করতে পারেন এ দুশ্চিন্তায় কাটতো কয়েক দিনরাত্রি।
আমাদের সময়ে নতুন বইর সঙ্গে লাইব্রেরীগুলোতে নোটবই কেনাও এক রকম বাধ্যতামূলক ছিল। বাংলা-ইংরেজি-অংক সহ প্রায় সব বইর নোটবই বিক্রি করলে বই বিক্রেতার বেশি কমিশন পেতেন বলে তাদের কাছে বই কিনতে গেলে বাধ্যতামূলক নোটবইও কিনতে হতো। এতে করে অভিভাবকদের বইকেনার বাজেট নিয়েও অনেক ভেবেচিন্তে চলতে হতো। পুরনো বইয়ের দোকানে কম বা অর্ধেক মূল্যে কেনা যেতো নোটবই। পড়া তৈরিতে যাদের সহায়তা করার কেউ নেই বা প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য নেই, তারা পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে নিতেন এমন পুরনো নোটবই। সব মিলিয়ে স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে বই কেনা-সংগ্রহ করা সবকিছুই ছিল বেশ ব্যয়বহুল হওয়াতে স্কুলে ঝরে হার ছিল বেশি। আজকের যুগের বাংলাদেশের শিক্ষার নানাকিছু পাল্টেছে। আমরা যে সব ফ্রি সরকারি প্রাইমারী স্কুলে পড়েছি, এখন গ্রামের বাড়ির ছেলেমেয়েরা সে সব স্কুলে এখন পড়ে কম। উপজেলায় উপজেলায় কিন্ডারগার্টেন সহ নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। স্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখন সে সব স্কুলে পড়ে।
এখন নানা সুযোগ সুবিধা স্বত্ত্বেও শিক্ষার মান বাড়ছে কী? এ নিয়ে নানান মত আছে। আমার ধারনা শিক্ষার মান সেভাবে না বাড়ার কারন ভালো শিক্ষকের সংকট। আপনি আপনার বাচ্চাকে এইম ইন লাইফ রচনা লিখতে দিন। সে লিখবে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার-পাইলট-বিজ্ঞানী এসব হতে চায়। সে শিক্ষক বা শিল্পী হতে চায় না। এমন বাংলাদেশে এখন শিক্ষকতায় যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। সে সব ক্ষেত্রে সুযোগ না পেয়ে তাদের অনেকে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও শিক্ষকতায় এসেছেন। অনেকে অন্য চাকরিতে সুযোগ না পেয়ে ঘুষের বিনিময়ে ঢুকেছেন শিক্ষকতায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব-পরিচালনার সঙ্গে জড়িত অনেকে প্রকৃত শিক্ষা বান্ধব নন।
আর আমরা সারাদিন কাঁঠাল গাছে চাইছি আম! কাঁঠাল গাছে যে শুধু কাঁঠালই হয়, আম হয়না এ সত্যটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ভুলে বসে থাকি। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা’র অতিরিক্ত আকাংখাও শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের অন্তরায়। তারা যে কোন মূল্যে চান জিপিএ-ফাইভ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়ান এক কোচিং থেকে আরেক কোচিং’এ। বাচ্চারা পাশ করছে। তার মেধার যথাযথ বিকাশ হচ্ছেনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় প্রায় বাচ্চাদের পড়াশুনায় বেশি চাপ না দিয়ে খেলার মাধ্যমে পড়ানোর কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশুনা করেছেন। এখন তাঁর নাতি-নাতনিরা বিদেশে পড়েন। এরজন্যে উন্নত বিশ্বের বাচ্চাদের পড়াশুনার পদ্ধতি জানেন। সেখানে বাচ্চাদের চাইতে বেশি পড়তে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষক হওয়া অনেক কঠিন সে সব দেশে। শিক্ষকদের থাকতে হয় নানান মনিটরিংএর মধ্যে। যা অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যে সমাজের শিক্ষক-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-সাংবাদিক-সরকারি কর্মচারীরা প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন সে সমাজ বিশৃংখল হয়। বাংলাদেশ এখন এমনই এক সামাজিক বিশৃংখলার ভিতর দিয়ে এগুচ্ছে।
খেলার মাধ্যমে পড়াশুনার নীতির কারনে বিদেশে বাচ্চারা স্কুলকে খুব উপভোগ করে। এই সময়ে বাচ্চাদের মধ্যে কে কোন খেলাধুলা বা শিল্প-সংস্কৃতিতে আগ্রহী সেভাবে তাদেরকে তখনই সেভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ পরিচর্যা করা হয়। এরজন্যে এসব দেশের খেলাধুলা থেকে শুরু করে নানান প্রতিভার পাইপলাইনের যোগানটি এতোটা হৃষ্টপুষ্ট হয়। বাচ্চারা স্বাস্থ্যবান ও লম্বাটে হয়। বাংলাদেশকেও সে পথে নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের মেধাবী প্রিয় প্রজন্মদের মেধার বিকাশের যথাযথ দায়িত্বটি পালন করতে পারবো। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা