ধর্ষণ যৌন নির্যাতনের একটা অংশ। ধর্ষণ সেটাই যেখানে বলপূর্বক করা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে ধর্ষণ নিয়ে অবাস্তব কথাবার্তা বলা হয়। সমস্যাটা হয়ে গেছে – ধর্ষণটা কেন হয় সেটাই আমরা বলতে পারছিনা। আমি কোন লেখাতেই পাইনা যে ছেলে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়।
এখন দেশে ধর্ষণ নিয়ে একধরণের জেন্ডার রাজনীতি শুরু হয়েছে। গত ৪০-৫০ বছরের ডাটাতে দেখা যায়, ধর্ষণ হয় ৫-৭ ভাগ। বাকি অন্য সব ধরনের যৌন হয়রানি হয় ৯৫ ভাগ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের মানুষ ধর্ষণ করে। পরিবার ধর্ষণ করার একটা কাঠামোর মতো। আমি ১৯৯৮ সালে শিশু যৌন হয়রানি নিয়ে সম্ভবত প্রথম গবেষণাটা করেছি। তখন দেখেছি পরিবারই মূল নির্যাতনের যায়গা। এটা নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাই না।
দ্বিতীয়ত, ধর্ষণ নারীদের সমস্যা না। এটা সকলের সমস্যা। ধর্ষণের ভিকটিম বেশিরভাগ বয়স্ক মেয়েরা হবে। কারণ তারা শারিরীকভাবে দূর্বল হবে। কারণ ছেলেশিশুরা ১২-১৩ বছর হলে প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু ছেলে শিশুরা নির্যাতিত হয় এটা নিয়ে কেউ কোন কথা তোলে না। এই জিনিসটাকে জেন্ডার পলিটিক্স না করলেও চলত। আমার মনে হয়, মানুষ এই বিষয়ে অজ্ঞ এবং অজ্ঞতা নিয়ে অহংকার করে। পৃথিবীর সব জাতি এটা করেনা, আমরা একমাত্র এই কাজটা করি।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শিশু এবং নারী নির্যাতনকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলছি। শিশুর কাঠামো আর নারী নির্যাতনের কাঠামো সম্পূর্ণরূপে আলাদা। আমরা ৪/৫ বছর আগে একটা গবেষণায় দেখেছি, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে যতগুলো প্রকল্প হয়েছে তার একটাও কোন উপকারে আসেনি।
আমাদের সমাজ একটা ধর্ষকবান্ধব সমাজ। আমরা ভাবি যে প্রতিবাদ করলাম, মানববন্ধন করলাম, তাহলে ধর্ষণ চলে যাবে। নারীকে ইজ্জত করলে ধর্ষণ থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রে তো নারীকে সম্মান না করলে জেলে দিয়ে দিবে। সেদেশে এত ধর্ষণ হয় কেন?
আমাদের সমাজে কেন ধর্ষণ হচ্ছে সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা দরকার। যুদ্ধের সময় এত ধর্ষণ হয়েছে কেন? কারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত। সুতরাং এই সমাজে অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। কেউ কি কখনো জিজ্ঞেস করে দেখেছে কি পরিমাণ চাপ আসে পরিবারে মেয়েদের হিজাব আর বোরখা পরানোর জন্য? ওরা কেন বোরখা পরে, হিজাব পরে। কারণ ওরা মনে করে এতে কেউ তাকাবে না । এই সমাজ যেখানে ধর্ষণবান্ধব সমাজ সেখানে ধর্ষণ কিভাবে কম হবে? আমাদের দেশে ধর্ষণ বাড়বে। কারণ আমাদের দেশে যেসব কাঠামোর কারণে নিরাপত্তা হয়, আইন শৃঙ্খলা হয়, সবলের একটু মেনে চলতে হয় প্রত্যেকটা আমরা ভেঙেছি এবং আনন্দের সঙ্গে ভেঙেছি। আমরা মনে করছি আমরা এটা একটা বিশাল অর্জন করছি।
আমাদের কি সাহস আছে? রাজনৈতিক কর্মী হলে এই ধরণের ধর্ষণ নিয়ে কোন কথা বলতাম না। ধর্ষণ নারীদের উপর হয় – এই ভাবনার কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হচ্ছে ধর্ষণকারিদের। কারণ যতদিন পর্যন্ত ধর্ষণ নারী সমস্যা হিসেবে থাকবে ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। এটা একটা সামাজিক সমস্যা। ধর্ষণের সঙ্গে নারীত্বের সম্পর্কটা কোন যায়গায়? নারীবাদীরাও আমার মনে হয় নারীদের ক্ষতি করছে। গত ২০ বছরে যত রিপোর্ট হয়েছে সেখানে দেখাক যে ধর্ষণ কমেছে।
বাংলাদেশ একটা মেধাবান্ধব সমাজ না। মেধাবান্ধব সমাজে যে গবেষণাটার প্রয়োজন সেটা এখানে করা হয়না। এখানে রাজনীতি ঢুকে পড়ে, বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি, ইনক্লুডিং জেন্ডার রাজনীতি যেটা আজকাল শুরু হয়েছে। এখানে নারীবাদী হতে পারলে সুবিধা পাওয়া যায়। তাই সবাই নারীবাদী হতে চাচ্ছে। সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কারও কোন আগ্রহ নাই। সবার ধারণা যে, আমার মেয়ের কিছু হবে না। আমার ছেলের কিছু হবে না। দেশের বেশিরভাগ এপার্টমেন্টে যৌন নির্যাতন হচ্ছে। কারণ বাবা-মায়েরা কতটুকু খেয়াল রাখবে। আমাদের দেশে এখন যে অবস্থা চলছে, চকলেট খাইয়ে, মোবাইলের গেম দিয়ে যৌন নির্যাতন করা হয়। সব যৌন নির্যাতনই ধর্ষণ কিন্তু আমরা ধর্ষণ বলতে পাবলিক প্লেসে যেটা হয় সেটাকে নিয়ে মাথা ঘামাই। যেটা সমস্ত ধর্ষণের মাত্র ৫ ভাগ। বাকি ৯৫ ভাগ পরিবারকেন্দ্রিক – কাজের যায়গা, পরিবারের যায়গা। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হয় কাজের মেয়েরা। আমাদের দেশে কোন আইন আছে যা কাজের মেয়েকে রক্ষা করে? যে উদ্যোগ গ্রহণ করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে তার কোন উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার ধর্ষকের বিচার প্রসঙ্গে একেক জন একেক কথা বলছে। কেউ বলছে, ক্রস ফায়ারে দিয়ে দেয়া হোক, ওকে হত্যা করা হোক, ওকে বলাৎকার করে হত্যা করা হোক। এতে বোঝা যায়, সহিংসতার মাত্রাটা আমাদের সমাজে কত? আমার সমাজ কত সহিংস তা নিয়ে আমি একটা গবেষণার কাঠামো দাড় করিয়েছি। এতে দেখা যায়, আমাদের সমাজ সহিংসতা প্রশ্রয়ী সমাজ। যেহেতু সকল পরিসরই সহিংস। কারণ আমরা তো মেনেই নিয়েছি ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ড । কারণ আমরা মনে করছি আমরাই নিরাপদে থাকব। মানব ইতিহাস হচ্ছে সে মনে করে যে সে নিরাপদে থাকবে সেটা যতই বেআইনী হোক সে সেটা মেনে নেয়। ঠিক যেমনিভাবে একাত্তর সালে গণহত্যার পক্ষে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ছিল। কারণ তারা ভাবত এতে তারা বাঁচবে, তাদের যে দেশটা পেয়েছে তা রক্ষা পাবে।
ভয় পাওয়া ছাড়া মানুষ সহিংস হয়না। আমাদের দেশের কোন মানুষ নিরাপদবোধ করে না। ঠিক তেমনিভাবে সে বলছে যে র্ধষককে খুন করে ফেল। একারণে আমাদের দেশে নিরাপত্তার অভাব যত বাড়ছে, সহিংসতা তত বাড়ছে। আমাদের নিরাপত্তাহীনতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আমরা মরব বা মারব এমন পর্যায়ে চলে গেছে। আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, ধষর্ণকারিকে যদি হত্যা না করি তাহলে আমাদের নিজের কন্যা ধর্ষিত হবে।
আফসান চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, সাংবাদিক।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা