অনলাইন ডেস্ক
পুলিশের এই বেপরোয়া কর্মকর্তা ওয়াসিমের একটি কল রেকর্ড এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে এক ভুক্তভোগীকে বলতে শোনা যায়, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।টাকা ১৭ হাজার তো মিলাইবার পারছি না। কালকে মিলাই দিই? ওই কর্মকর্তা বলেন, বুঝি নাই।’ তখন ভুক্তভোগী বলেন, ‘টাকা তো সব মিলাইবার পারছি না।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘তোরে মাইরালামু; কিন্তু এ্যাকে বারে মাইরা ফেলামুরে। স্যার, মারেন কাটেন যা করেন; আল্লাহ যদি বাঁচাই রাখে কালকে টাকা দিয়া আমু। এত কথা কয়া অবে না। তোরে তাড়াতাড়ি আইতে কইছি, তুই আয়।’
এ ছাড়া আরও কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ এসেছে কালবেলার হাতে। একটি ফুটেজে দেখা যায়, গত শনিবার রাত ৮টার দিকে বাউনিয়ার একটি গ্যারেজ থেকে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত লাইনম্যান জসিম ৫০০ টাকা করে তুলছেন। প্রতি শনিবার ফাঁড়ির পুলিশের নাম বলে বাউনিয়া এলাকার প্রায় শতাধিক গ্যারেজ থেকে তোলা হয় এই টাকা। এ ছাড়া বৈধ-অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইজিবাইক (মিশুক) ও অটো গ্যারেজ, লেগুনা স্ট্যান্ড, পাকার মাথার অটোস্ট্যান্ড, বটতলা ফুটপাতে বসা ফুচকার দোকান, চা দোকানসহ বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে মাসে অন্তত কয়েক লাখ টাকা তোলা হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
আইসি আলামিনের ‘আদালত’: গত ২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি সারাদিন সরেজমিন দিয়াবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার বাউনিয়া দক্ষিণ ও উত্তর পাড়া, বটতলা, সুলতান মার্কেট, বাউনিয়া বাজার, বাদালদি, উলুদাহা, তাফালিয়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে অন্তত ২০ ভুক্তভোগীর সন্ধান পায় কালবেলা। তারা কালবেলাকে নগদ-বাকিতে আসামি ছাড়ার বিস্তারিত জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোর্সের সহায়তায় নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রথমে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বাউনিয়া বটতলার সিভিল এভিয়েশনের গার্ড রুমে। এরপর সেখানে ফাঁড়ি ইনচার্জ (আইসি) সালিশ বসান। ওই সালিশি সভায় রাজাসনে বসেন আইসি আলামিন নিজেই। জরিমানা করা হয় খেয়ালখুশিমতো। তাৎক্ষণিক কেউ সেই টাকা দিতে না পারলেও কোনো সমস্যা নেই। সুযোগ রয়েছে কিস্তিতে পরিশোধের। এই গার্ড রুমের সালিশির ভিডিও কালবেলার হাতে রয়েছে। তবে কেউ কথা না শুনলে নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। ভয়ভীতি দেখিয়ে ও মিথ্যে মামলা দিয়ে নানাভাবে করা হয় হয়রানি।
সরেজমিন খুঁজে পাওয়া যায় কল রেকর্ডের সেই ব্যক্তিকেও। তার নাম মো. জাবেদ। পেশায় রিকশাচালক। জাবেদের স্ত্রী গার্মেন্টসে কাজ করেন। জানতে চাইলে ভুক্তভোগী জাবেদ কালবেলাকে বলেন, ‘রাস্তা থাইকা ধইরে নিয়া যায় ওয়াসিম স্যার। পরে বলে আমি না কি মাদক বেচি। আমার কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করে। না দিলে মাদক দিয়ে চালান দেবে বলে জানান। মামলার ভয়ে ধারকর্জ করে ৩ হাজার টাকা জোগাড় করে দিই ওয়াসিম স্যারকে। বাকি ১৭ হাজার টাকা রিকশা বিক্রি করে দিতে বলে আমাকে ছেড়ে দেয়।’
নুরুল হোসেন নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, বাড়ির ড্রেনের কাজ করছিলাম। এমন সময় আইসি আলামিন এসে কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে কাজ করতে দেন। আরেক ভুক্তভোগীর পরিবার জানান, গত মাসে বাসার গলিতে যাওয়ার সময় ফাঁড়ির এএসআই ওয়াসিম তাকে ধরে বলে রড চুরি করতে এসেছি। ছেড়ে দিতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। রাজি না হলে চোর হিসেবে চালান দেওয়ার ভয় দেখিয়ে রাত ৩টা পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের গার্ডরুমে আটকে রাখে। পরে ২০ হাজার টাকায় রাজি হন। রাতেই সঙ্গে থাকা ৩ হাজার টাকা নেন। পরের দিন সকালে তার ব্যক্তিগত সোর্স পাঠিয়ে বাসা থেকে বাকি ১৭ হাজার টাকা নেন। এ ছাড়া বাদালদি জামে মসজিদের সামনে ওয়াজ মাহফিল চলাকালে বাসার পাশেই বসেছিল বাবু (১৫) ও তার বন্ধু আলামিন (১৬)। সেখানে ওয়াসিম তাদের মারধর করে চুরির মামলার ভয় দেখিয়ে দুই পরিবারের কাছে থেকে ৬ হাজার করে ১২ হাজার টাকা নেন।
জানতে চাইলে বাবুর মা কালবেলাকে বলেন, ওয়াসিমের অত্যাচারে এলাকায় থাকা দুষ্কর। আমার ছেলে ভয়ে এখন বাসা থেকে বের হয় না। তারে ধরে চোর বানানোর নাটক করে মারধর করেছে। আবার ৬ হাজার টাকা নিয়েছে। আমি মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করি। এই ৬ হাজার টাকা কর্জ করে দিছি। পুরান পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে তাফালিয়া রোডের এক নারী চায়ের দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার দোকানে ফাঁড়ির এএসআই খাইরুল স্যার আইসা চেক করে সব মালপত্র ফালাই দেয়। বলে আমি না কি দোকানে মাদক বেচি। কিছু না পেলেও দোকানের মাল কেনার জন্য রাখা সাড়ে ৭ হাজার টাকা নিয়ে যায়। টাকা ফেরত পেতে ফাঁড়ির আইসি আলামিনের কাছে বিচার দিই। কিন্তু আলামিন স্যার ফেরত দেওয়ার কথা বলে আর দেয়নি।’
ওই দোকানে বসা সাত-আটজন যুবকের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তারা প্রত্যেকেই জানান ফাঁড়ির পুলিশের অত্যাচারের কথা। তাদের ভাষ্যমতে, ফাঁড়ির পুলিশের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া মো. ওয়াসিম। এলাকায় বেশিরভাগ সময়েই এ অফিসার সিভিলে থাকেন। তার যখন যাকে খুশি ধরে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে ইচ্ছেমতো টাকা নেন। চাহিদামাফিক টাকা না দিলে দেওয়া হয় মিথ্যে মাদক মামলা। এ নিয়ে এলাকার যুবকরা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। তারা জানান, কিছুদিন আগে সাইফুদ্দিন ওরফে সুন্দরী নামে এক ছেলেকে ধরে পুলিশ। ছেলেটা একটা অটোরিকশা বানানোর কোম্পানিতে চাকরি করত। তার কাছে ২ লাখ টাকা চায়। টাকা না দেওয়ায় ২০০ পিস ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট দিয়ে দেন মামলা। তারা জানান, এএসআই ওয়াসিমের সঙ্গে সবসময় ছোট একটি ব্যাগ থাকে। ওই ব্যাগে থাকে মাদক। যারে-তারে ধরে নিজের সঙ্গে থাকা মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেন।
স্থানীয় লোকজন এই প্রতিবেদককে অন্তত ১৫টি ভিডিও দেন এএসআই ওয়াসিমের অত্যাচারের। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, রাতে স্থানীয় মানুষের ব্যাপক তোপের মুখে পড়েছেন এএসআই ওয়াসিম। ওয়াসিম শার্টের বোতাম খুলে কানে হেডফোন লাগিয়ে লাঠি হাতে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। স্থানীয়রা বারবার বলছেন, আপনি একজন মানুষকে ল্যাংটা করে রাস্তায় ফেলে পেটাতে পারেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাদালদি ছয়তলা এলাকার যুবক সুজন নামে এক ব্যক্তি বাসার পাশের গলি দিয়ে ঘরে যাচ্ছিলেন। গলি থেকে তাকে ধরে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান ওয়াসিম। এক পর্যায়ে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক রিকশা গ্যারেজ মালিক বলেন, নিয়মিত আমাদের থেকে টাকা নেয়। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাকে একটা মোটরসাইকেল দিছে। সেটা দেখে ওয়াসিম বলেন, তার নাকি ওই মোটরসাইকেল পছন্দ হয়েছে। এখন এই মোটরসাইকেল চায়, নাহলে আর একটা কিনে দিতে বলে। মো. আদর নামে এক গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ী কালবেলাকে বলেন, আমি যাচ্ছি, এ সময় এক লোক ডাক দিয়ে বলেন, দাঁড়ান দৌড় দেবেন না। আমি পুলিশের লোক। এরপর আমাকে চেক করে কিছু পায়নি। আমার কাছে ১৭ হাজার টাকা ছিল। ওইটা নিয়ে গেছে। পরে আমি টাকা চাইলে বলেন, আমি পুলিশের লোক, টাকা পাবেন না। বেশি কথা বললে মামলা দেব।
মাদকসহ পেয়েও ছেড়ে দেন ওয়াসিম: ময়মনসিংহের রাজিব পেশায় অটোরিকশা (মিশুক) চালক। গত মাসের শেষের দিকে বাউনিয়া আব্দুল জলিল স্কুলের পেছনের একটি গ্যারেজ থেকে দুপুরে একশ গ্রাম গাঁজাসহ তাকে আটক করেন এএসআই ওয়াসিম। ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে দাবি করেন ১ লাখ টাকা। অনেক দেনদরবারের পরে ৩০ হাজার নগদ ও ১০ হাজার টাকা বাকিতে তাকে ছেড়ে দেন। পরে এই খবর জানতে পারেন ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আলামিন। এরপর গ্যারেজ মালিককে সন্ধ্যার দিকে বটতলা সিভিল এভিয়েশনের গার্ড রুমে ডেকে এনে আরও ৩০ হাজার টাকা নেন আইসি। এ ছাড়া তিন দিন পর সোর্স মারফত বাকি ওই ১০ হাজার টাকা নেন ওয়াসিম।
জানতে চাইলে এএসআই মো. ওয়াসিম কালবেলাকে বলেন, আমি মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করি। যারা আমার কারণে এলাকায় মাদক বিক্রি করতে পারছে না, তারাই এসব অভিযোগ দিচ্ছে। এলাকায় অন্তত অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগী আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বাউনিয়া এলাকার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ যুবসমাজ মাদকাসক্ত। অর্ধশতাধিক নয়, আপনি আরও পাবেন। অন্তত ১ হাজার পাবেন। এরপর তিনি বলেন, কাজ করলে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। কোনো ভুল করলে ছোট ভাই বা বড় ভাই হিসেবে দেখিয়ে দেবেন, শুধরে নেব।
ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) উপপরিদর্শক টিএম আলামিন কালবেলাকে বলেন, এই ফাঁড়ির কোনো বসার নির্দিষ্ট কক্ষ বা জায়গা নেই। যে কারণে আমরা লোকজন ধরে সিভিল এভিয়েশনের গার্ড রুমে রাখি। টহল গাড়ি এলে দিয়ে দিই। নগদ-বাকিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে বলেন, এসব মিথ্যা ও অসত্য।
জানতে চাইলে উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শাহাজাহান কালবেলাকে বলেন, এসব বিষয়ে আমি জানি না। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। কেউ যদি এসব করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কয়েকজন ভুক্তভোগীকে আপনি একটু আমার কাছে পাঠান। আমি তাদের অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা নেব।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, পুলিশের চাকরি করে অন্যায় করার কোনো সুযোগ নেই। প্রতি এলাকাতেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। কারও সঙ্গে এমন কিছু ঘটে থাকলে অবশ্যই তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করতে হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেকে অভিযোগ করতে ভয় পায়। কিন্তু ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ দিতে হবে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা