ডাঃ রাজীব দে সরকার : কোভিড-১৯ পরিস্থিতিটা ‘হয়তো’ স্বাস্থ্য বিভাগ কিছুটা বাগে আনতে শুরু করেছিলো।
কিন্তু আমাদের অদূরদর্শী আচরণ পুরো পরিস্থিতিতে মুড়িঘন্টের ডালের মতো ঘুটে দিয়ে চলে গেলো। করোনা ভাইরাসটাকে নিজেরাই সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার এই মহাযজ্ঞ পুরষ্কার পাবার দাবী রাখে!
– ভাবুনঃ
– স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সবাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে গেলো কক্সবাজার, সাজেক।
– ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হলো। সব মানুষ এটাকে মনে করলো বাড়িতে বেড়াতে যাবার ছুটি। নাড়ির টানে বাস-ট্রাক-লঞ্চ-ট্রেন ভরে সবাই বেরিয়ে পড়লো। যেন এক উৎসব!
– ছুটি শেষে আপনাদের দপ্তর প্রধানরা অফিস-কারখানা বন্ধ রাখবেন কী না তা-ই সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না, আপনারাও হৈ হৈ রৈ রৈ করে আবার ফিরে এলেন শহরে। আবারো উৎসব!
– তাহলে লাভ কি হলো এই কয়দিন ঘরে থেকে? কার জন্য, কিসের জন্য ঘরে থাকলেন?!
– লাভ কি হলো, আমাদের এতো এতো উপদেশ এর?
– তাহলে এখন আর হটলাইনে ফোন দিলেই কি, আর না দিলেই বা কি? এখন আর ডাক্তাররা-নার্সরা চিকিৎসা সেবা দিলেই কি, আর না দিলেই বা কি? এখন আর প্রাইভেট চেম্বার খুলে রাখলেই কি, আর না রাখলেই বা কি? এখন ১ জায়াগার বদলে দেশের ১০ জায়গায় টেস্ট করালেই কি, আর না করলেই বা কি? প্রতিদিন নতুন কতো জন আক্রান্ত হলো, নতুন কতো জন মারা গেলো, এটাই বা শুনে লাভ কি?
– পুরো জাতির অপরিণামদর্শিতার দায় কি শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের? শুধু একটি মন্ত্রনালয়ের?
স্বাস্থ্য বিভাগের কথা বলাতে একটা জিনিস মনে পড়লো।
আমি গ্রামে বড় হইনি। তবে গ্রামের ‘তেলের ঘানি’র গল্প শুনেছি। একটা গরু বা বলদ দিয়ে ঘানিতে তেল ভাঙানো/মাড়াই করা হয়। গরু বা বলদটার কাঁধে একটা ‘জোঁয়াল’ দিয়ে তাকে চক্রাকারে একই পথে হাঁটানো হয়। গরু থেমে গেলে তাকে চটাং করে আঘাত করা হয়। আরো মজার কথা (পড়ুন অমানবিক) হলো, গরু/বলদটা চোখে কালো কাপড়/গামছা বাঁধা থাকে। যাতে করে গরুটার মনোযোগ ঘাস বা নিজের বাছুরটার ক্ষুধার্ত মুখের দিকে বা অন্য কোন দিকে চলে না যায়। এভাবেই গরুগুলো ঘুরে ঘুরে তিলে তিলে গড়ে ভরে তোলে তেলের পাত্র।
রাজপথে যে জনস্রোতের ছবি গতকাল দেখলাম, এগুলো দেখে অন্তঃত আমরা শিঁউরে উঠেছি।
চিকিৎসক হবার পর থেকে কম মৃত্যু তো আর আমরা দেখিনি। মৃত বাবা-মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট লিখে তার সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার কাজটা আমাদের কতোখানি অপ্রিয়, শুধু আমরাই জানি। এই কাগজটার ভার কতোখানি, শুধু জানি আমরা আর ঐ স্বজন হারানো মানুষটি।
কাল যারা সারা দেশ চষে এদিক সেদিক ছুটলেন, আজ যারা ছুটছেন, তাদেরকে সরাসরি দোষ দিচ্ছি না। পেটের দায়েই হয়তো ঘরে থাকা হয়নি তাদের। তবে করোনার মৃত্যুমিছিলে কিন্তু দোষী-নির্দোষ কেউই বাদ পড়বেনা।
এখনো হয়তো বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি, বা আমাদের অনুধাবন করতে দেওয়া হয়নি। যে রোগটা আমরা গায়েই মাখাচ্ছি না, মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯০০০ এর বেশী মানুষ এখন মৃত সেই রোগে!
এখন নিজের লেখাগুলো নিজের কাছেই ‘অবান্তর’ মনে হয়।
ঘানির বলদের মতো শুধু চক্রাকারে শ্রম দিয়ে যেতে হবে এখন। চোখে কালো কাপড়। আর ‘বাছুর’ কিংবা ‘ঘাস’ – কোন কিছুর দিকেই তাকানোর আর কোন সুযোগ নেই।
ভালো থাকুক আমাদের ‘অদেখা’ বাংলাদেশ। ভালো থাকুক ‘সকল’ কিছুর দায় বয়ে চলা অননুপ্রাণিত ‘স্বাস্থ্য বিভাগ’
# ডাঃ রাজীব দে সরকার, রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা