রাজীব দে সরকার
লেখাটা যিনি লিখেছেন তিনি যে পক্ষপাতদুষ্ট সেটা সন্দেহাতীত। তবে তিনি রোগীদের পক্ষে বলে মনে হয়নি আমার কাছে। বরং তিনি চিকিৎসকদের বিপক্ষে।
ব্যাখ্যা দিচ্ছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় যে নির্দেশনাটি দিয়েছেন তা চিকিৎসকদের স্বার্থে না। বরং এই নির্দেশনা চিকিৎসক, সেবিকা, ওটি বয়, ওয়ার্ড বয়, ওয়ার্ড মাস্টার, টেকনোলজিস্ট সহ হাসপাতালে রোগী সেবার সাথে জড়িত তাদের সবার স্বার্থেই। সামগ্রিক অর্থে এই নির্দেশনা রোগীর স্বার্থেই। ধরুন দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রন হলে যদি ইনফেকশন এর মাত্রা কমে, তাহলে লাভবান কে হবেন? ইনফেকশন কম হলে যদি রোগী বা তার স্বজন অপেক্ষাকৃত কম সময়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন তাহলে লাভবান কে হবেন? একজন রোগীর সাথে আসা ১০ জন দর্শনার্থীকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, অন্য একজন রোগী কি উপকৃত হবেন না? তাহলে আমার প্রশ্ন, চিকিৎসকদের প্রসঙ্গ এলো কেন এখানে? চিকিৎসকদের রোগীদের বিপক্ষে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যটা কি?
যাই হোক, এসব জোর করে কাউকে বোঝানো যায় না। বোঝার মানসিকতাও রাখতে হয়। পারবেন সচিবালয়ে হুড়মুড় করে ১০ জন ঢুকে যেতে?
অথচ সচিবালয় এর থেকে হাসপাতালে ওয়ার্ড আরো বেশী সংবেদনশীল এলাকা।
এবার আসি চিকিৎসকদের প্রসঙ্গটায়।
দেখুন, সংবাদ মাধ্যম, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, রাজনৈতিক নেতারা সবাই ই কিন্তু রোগীদের স্বার্থ দেখছে। ডাক্তারদের স্বার্থ কে দেখছে আমাকে একটু জানান। কারন আমি সত্যি জানি না।
এদেশে চিকিৎসকদের নামে ক্রিমিনাল কেইস হচ্ছে। মানে কাউকে চিকিৎসা দেওয়াও এক ধরনের ফৌজদারী অপরাধ। মামলার এজাহারে চিকিৎসক এর নামে কি লেখা থাকে কেউ কি কখনো পড়ে দেখেছেন? একজন চিকিৎসক কি কোনদিন একজন রোগীকে মেরে ফেলার জন্য চিকিৎসা দেন? অথচ “হত্যা করার উদ্দেশ্যে” এই কথাটি লেখা থাকে। আচ্ছা, একজন উকিল কি মামলা জেতানোর গ্যারান্টি দিয়ে মামলা লড়েন? তাহলে উকিলদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না কেন?
চিকিৎসককে মারা হচ্ছে (অজস্র ঘটনা আছে, একটি দুটি নয়)। চিকিৎসকদের নামে নামসর্বস্ব নিউজ জার্নালে ইচ্ছে মতো মনগড়া রিপোর্ট হচ্ছে। রোগীর স্বজন বললো, “ভুল চিকিৎসা” আর সাংবাদিকরাও লিখে দিলো “ভুল চিকিৎসা”।
চিকিৎসককে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গালি গালাজ করা হলো।
অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ স্যারের কথা ভুলে যান নি আশা করি। যে অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ স্যারকে ভুল চিকিৎসার জন্য মামলা দিয়ে আদালতে নেওয়া হয়েছিলো, তিনি আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রধান চিকিৎসক’। তাহলে কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন আসামীকে সচিব মর্যাদায় নিয়োগ দিয়ে ভুল করলেন? প্রশ্নটা সে সময়ে ফেসবুকে বিপ্লব করা মানুষগুলোর জন্য রইলো। ঐ ঘটনায় আব্দুল্লাহ স্যারের মতো আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসককে কি অপমানটাই না করা হয়েছিলো।
ক্ষণজন্মা এমন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আপনারা আর কোনদিন পাবেন বলে আমি বিশ্বাস করি না, কারন এই ঘটনার পরে অনেক অনেক নবীন চিকিৎসক কিংবা মেডিকেল স্টুডেন্ট বিদেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটু খোঁজ নিন, বাংলাদেশের ডাক্তাররা কতো সুনামের সাথে উন্নত বিশ্বে কাজ করছেন।
যে দেশে অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ স্যারের নামে রোগীর চিকিৎসার জন্য ফৌজদারী মামলা হতে পারে, সে দেশে কাউকে চিকিৎসা দেওয়ার আগে চিকিৎসকদের ১০ বার ভাবা উচিৎ। অথচ এদেশে হলুদ সাংবাদিকতা বা মিথ্যা রিপোর্টিং এর কোন শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই।
বরং আমি মনে করি, চিকিৎসকদের পাশে কেউই নাই। চিকিৎসক সংগঠনগুলো পর্যন্ত প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এক একজন চিকিৎসক তার প্রোফেশনাল ফিল্ডে বড্ড একা।
রোগীদের সুচিকিৎসার স্বার্থেই দর্শনার্থী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের চলাচল হাসপাতালে অবাধ হওয়া উচিৎ না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ঘুরে দেখে আসুন, সেখানে হেলথ জার্নালিজম কিভাবে করা হয়। দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে তো হাসপাতালের ওয়ার্ড আইসিইউ তে যাবার প্রয়োজন নেই।
দেশীয় হাসপাতালে রোগীরা সেবা না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে এই মূর্খতা নিয়ে সাংবাদিকতা না করাই ভালো। তাহলে প্রতিদিন সরকারী হাসপাতাল গুলোতে আমরা যে লক্ষাধিক মানুষকে সেবা দিচ্ছি ওরা কোন দেশের মানুষ।
কেউ বিদেশ যাবে কি যাবে না, সেটা দিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানদন্ড হিসেব করা চলে না। যিনি পোস্ট লিখেছেন তিনি কি ওয়ালটন এর মোবাইল ব্যবহার করেন? দেশী মোবাইল অপারেটর টেলিটক থাকতে অন্য অপারেটর কেন ব্যবহার করি আমরা? দেশীয় টিভি চ্যানেল রেখে অন্য চ্যানেল আমরা দেখি না? কারো অপশন বেছে নেওয়ার অধিকার তার ব্যক্তিগত। সেটা দিয়ে কোন সার্ভিসকে জাস্টিফাই করা চলে না।
মন্ত্রনালয় একটি সুষ্ঠ চিকিৎসা পরিবেশ চেয়েছিলো হয়তো। তাতে উপকৃত হতো সবাই। অকৃতজ্ঞতার ইতিহাস আমাদের বহু প্রাচীন। তাই এসব নিয়ে কিছু আর বলতে ইচ্ছে করে না।
সুস্থ থাকুক দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল শত্রুরা।